স্বল্প স্যংখক যে কয়েকজন কবি ভারতীয় ইংরাজি
কবিতার স্বতন্ত্র মানচিত্র নির্মাণ করেছেন,আঘা শাহিদ আলি তাঁদের মধ্যে অন্যতম।১৯৪৯ সালে কাশ্মীরে
জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর আঘা শাহিদ
আলি আমেরিকার ম্যাসাচুয়েটস আমহারস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যাপনা করতেন।
এ ওয়াক থ্রু ইয়েলো পেজেস,দা হাফ ইঞ্চ হিমালয়াস,এ নস্টালজিয়াস ম্যাপ
অফ আমেরিকা,দা কান্ট্রি উইদাউট পোস্টঅফিস, রুমস আর নেভার ফিনিসড
প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।দা রেবেলস সিল্যুয়েট,এই নামে ফয়েজ অহমদ
ফয়েজ এর কবিতার অনুবাদ করেছিলেন তিনি। ইন্দো-ইসলামিক কাব্য শৈলীর সাথে সমসাময়িক আখ্যানরীতির এক স্বপ্নসম্ভব
সংমিশ্রণ ছিল তাঁর কবিতার শৈলীতে। ব্যক্তিগত স্মৃতি,উপমহাদেশের জিওপলিটিক্স,পুড়ে যাওয়া কাশ্মীর,রাষ্ট্রের দমননীতি, রক্তক্ষরণ, মৃত্যু,বিষাদ বারবার ফিরে
এসেছে তাঁর কবিতায়। ২০০১ সালে ব্রেন ক্যান্সারে ম্যাসাচুয়েটসে মৃত্যু হয় তাঁর।
আঘা শাহিদ আলির দুটি কবিতা
বিদায়
ঠিক ঐ জায়গাটাতেই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি
ওরা একটি নৈশব্দ তৈরি করেছিল আর তার নাম দিয়েছিল শান্তি।
তুমি চলে যাওয়ার পর সবকটা পাথর পুঁতে দেওয়া হয়েছিল
বিক্ষোভকারীদের কাছে আর কোন অস্ত্রই ছিল না তখন
তাহলে পাহাড়ি ছাগলগুলো যখন পাথরে গা ঘষবে
তখন কে ওদের খসে পড়া পশম মাটি থেকে কুড়িয়ে নেবে?
পশমিনা বানানোর লোকগুলিও ত অনেকদিন হয় নেই
তাহলে দাঁড়িপাল্লায় ঐ আঁশগুলি কারা মেপে নেবে এখন?
ওরা একটি শূন্যতা তৈরি করেছিল আর তার নাম দিয়েছিল শান্তি
জন্নতের দরজায় তাহলে আজ কে দাঁড়িয়ে থাকবে পাহারা দেওয়ার জন্য?
আমার স্মৃতি আবার তোমার ইতিহাসের দিকে চলে যাচ্ছে।
মরুভূমির কারাভানের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে ফৌজি কনভয়
ধোঁয়া,চুইয়ে পড়া মবিল আর হেডলাইটের আবছা আলোয়
মিশে যাচ্ছে শীতকাল আর কুঁকড়ে যাওয়া জয়ত্রী ফুল।
আমরা কিছুতেই ওদের ঐ প্রশ্নটা করতে পারছিনাঃ
'এই পৃথিবীতে তোমাদের
কাজ কি শেষ হয়েছে?'
লেকের জলে মন্দির আর মসজিদের প্রতিবিম্বগুলি
একে অন্যের হাতগুলি জড়িয়ে ধরে আছে।
তুমি কি জাফরান ভিজিয়ে রেখেছ ওদের ওপর ছেটানোর জন্য?
তোমার ছায়ার সাথে আমি এই দৃশ্যটা সেলাই করে দিচ্ছি
অনেক বছর পরেও এই দেশে এভাবেই থাকবে ওরা
এই দেশে আমরা দরজাগুলো হাতে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি।
বাচ্চারা জানালাগুলো খুলে নিয়ে দৌড়তে থাকে
তুমিও তো একটা জ্বলতে থাকা বারান্দা টেনে নিয়ে যাচ্ছ।
একটা সুইচ টিপলেই সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে যাবে তুমি।
ঠিক ঐ জায়গাটাতেই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি
অথচ তুমি আমাকে চাইছিলে,আমাকে গড়ে নিতে চাইছিলে
তুমিঃ
তোমার অনুপস্থিতি আমাকে তোমার শত্রু বানিয়ে ফেলেছিল।
তোমার ইতিহাস আমার স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ছিল।
আমাকে তুমি হারিয়ে ফেলেছ,ক্ষমা করতে পারবেনা
তুমি আমাকে
আমি একজন গুমসুদা মানুষ,তোমার শত্রু।
তোমার স্মৃতি আমার স্মৃতির ভেতর ঢুকে পড়ছিল বারবারঃ
কেউ আমাকে জহন্নমের নদীর ওপর দিয়ে জন্নতের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলঃ
বোকা ভুত,এটা একটা রাত্রি।
নৌকোর দাঁড়টাই আসলে হৃদয় যেটা পোর্সিলিনের ঢেউগুলো ভাঙ্গছিলঃ
এখনো রাত শেষ হয়নি। আর দাঁড়টা আসলে পদ্মফুলঃ
আমি ভেসে যাচ্ছিলাম...প্রাণহীন ...শুধু একটা মৃদু বাতাসের ডানা
আমাকে দয়া করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
যদি তুমি কোনদিন আমার হতে তাহলে কী
এই পৃথিবীতে কিচ্ছু হত না?
আমার সর্বস্ব তুমি হারিয়ে ফেলেছ।আমাকে ক্ষমা করতে পারবে
না তুমি।
আমার স্মৃতি তোমার ইতিহাসের রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে।
আমাকে ক্ষমা করার কোন কারন নেই,তুমি আমাকে ক্ষমা কোর
না
আমার ক্ষতচিনহ্নগুলি আমি নিজের কাছেই লুকিয়ে রেখেছি
আমার যন্ত্রণা শুধু আমিই বুঝতে পারব।
দুনিয়ার সবকিছু ক্ষমা করে দেওয়া যায়।তুমি আমাকে ক্ষমা কোর
না।
শুধু যদি কোনদিন তুমি আমার হতে পারতে
কতকিছুই না করে ফেলা যেত এই পৃথিবীতে!
মাঝরাতের নয়া দিল্লিতে দাঁড়িয়ে আমি কাশ্মীরকে দেখছি
১.
সমতলের মানুষদের বরফের রত্ন পরা উচিত
দুরের পাহাড়গুলিকে কাঁচের ওপর ডেকে আনার জন্য
ঐ শহরটার থেকে কোন
খবর আসে না আর
অথচ এই কার্ফুর রাতেই সবকিছু খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে
যেন ঐ ভয়ানক বিষয়গুলিই খুব সংক্ষিপ্তঃ
জিরো ব্রিজের ওপর থেকে সার্চলাইটগুলি একটা ছায়াকে
ধাওয়া করছে আর ছায়াটা দৌড়ে দৌড়ে
শুধু নিজের শরীর খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ক্যান্টনমেন্টের কাছে গুপকার রোডের
শেষ মাথায় ছায়াটা ছোট হতে হতে উধাও হয়ে গেল
গেটের লোকজনও দেখতে পেলনা ছায়াটাকে
চেকিং পার হয়ে দিব্যি সে ঢুকে পড়ল জেলের অন্ধকারে।
একটা জ্বলতে থাকা টায়ার থেকে আগুন গলে পড়ছিল
একজন কয়েদির পিঠের ওপর,
বারবার ককিয়ে উঠছিল ছেলেটা,'আমি কিচ্ছু জানিনা।'
২.
আবার বাইরে বেড়িয়ে এল ছায়াটা আর বলল,
'আমাকে শান্ত কর',ওখানে পাঁচশ মাইল দূরে
জনহীন,ফাঁকা শ্রীনগরে
জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিলাম আমি
কিন্তু ওকে শান্ত করার মত কোন শব্দ আমার জানা ছিল না
রেসিডেন্সি রোডে,মীর পান হাউসের পাশে দাঁড়িয়ে কোনমতে
কথা বলছিলাম আমরাঃ'আমি শব্দগুলো বিশ্বাস করি
(একদিন তুমিই ঐ কথাগুলো বলেছিলে আমাকে)
শরতের হাওয়ায় যখন বরফ ভেসে আসে,চিনারের পাতাগুলি
কখনও একসাথে,কখনও একা একা ঝরে পড়ে।'
'রিজওয়ান,এটা তো তুমি,তুমিই তো রিজওয়ান!'
ছায়াটা আমার কাছে আসতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ওর ফিরহানের হাতাদুটো ছিঁড়ে কোনমতে ঝুলছিল
'প্রতিরাতে কাশ্মীরকে
তোমার স্বপ্নের ভেতর ডেকে নিও'
বলতে বলতে রিজওয়ান ছুঁয়ে দিল আমাকে
বরফের মত ঠাণ্ডা দুটো হাত,আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে
বলল 'আমি অনেকদিন আগেই
মরে বরফ হয়ে গিয়েছি।'
৩.
'আমার আব্বাকে বোলো
না যে আমি মরে গেছি।'
রক্তে ভেসে যাওয়া রাস্তার ওপর দিয়ে আমি রিজওয়ানের পেছনে
দৌড়তে লাগলাম আর রাস্তার ওপর শয়ে শয়ে জুতো পড়ে ছিল
জানাজা নিয়ে যাওয়ার সময় গুলি খেয়ে মরেছিল মানুষগুলি
বাড়ির জানালাগুলি দিয়ে মায়েদের কান্না ভেসে আসছিল
আর শুকনো ছাইয়ের মত আমাদের ওপর বরফ ঝরে পড়ছিল
কালো ছাইয়ের মত আগুনে পুড়ে যাওয়া বরফ
জ্বলতে থাকা বাড়িগুলির আগুনও নেভানো যাচ্ছিল না।
মাঝরাতে সেনারা ঐ বাড়িগুলি জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল কাশ্মীরঃ
ঝলসানো আলোর ভেতর আমরা দেখলাম
মন্দির থেকে মূর্তিগুলি সরিয়ে নিচ্ছিল কয়েকজন
আমরা ওদের বললাম,'তোমরা এখান থেকে চলে গেলে
কে বাঁচাবে আমাদের?'
কোন কথা না বলেই মূর্তিগুলোকে বুকে আঁকড়ে ধরে
উধাও হয়ে গেল লোকগুলো উৎরাইয়ের রাস্তায়
৪.
আমি তোমার আব্বাকে বলব না রিজওয়ান যে তুমি মারা গেছ
কিন্তু কোথায় পড়ে আছে তোমার ছায়া?
কোন পীরের মাজারের চাদরের মত,
দাফন না হওয়া কোন ছেলের বুলেটে ঝাঁঝরা শরীরের মত
কোথায় পড়ে আছে তোমার ছায়া?
ঠিক তোমার মত ছেলেটারও রক্ত ঝরছে হিমালয়ের বরফের
ওপর আর ঠাণ্ডায় জমতে জমতে চুনি হয়ে যাচ্ছে
শাহ্ হামদানের মাজারে আমি একটা সবুজ সুতোয়
গিঁট বেঁধে রেখেছিলাম তোমার জন্য,তুমি ফিরে আসবে
আর শেষ হয়ে যাবে এইসব ভয়ানক মৃত্যু।
কিন্তু কার্ফুর শহর থেকে কোন খবরই পাওয়া যায়না
তোমার ছায়াও ফিরে আসে না আর
পাঁচশ মাইল পার হয়ে আবার ফিরে এসেছি আমি
আমার হাত থেকে খুলে ফেলছি বরফের রত্ন
পাহাড়ের পাথরগুলি আবার শক্ত গ্রানাইট হয়ে যাচ্ছে
আমি আবার দেখছি,বরফের বাড়িঘর থেকে নেমে আসছে মানুষগুলি
আর বাচ্চাদের মত ওদের কোলে ঘুমিয়ে আছে দেবতারা।
ভাষান্তরঃ শৌভিক দে সরকার
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন