কবিতা ভাষান
রুদ্রামূর্তি চেরান :
সাম্প্রতিক তামিল কবিতার অন্যতম
কণ্ঠস্বর রুদ্রামূর্তি চেরান। ১৯৬০ সালে
শ্রীলংকার জাফনায় জন্মগ্রহণ করেন চেরান।১৯৮৩ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ইরান্দাভাদু সূর্যা উদইয়ম' প্রকাশিত হয়।দীর্ঘ তিন দশকেরও
বেশি সময় ধরে জাতিদাঙ্গা,গৃহযুদ্ধে দীর্ণ শ্রীলংকার রক্তাক্ত ইতিহাস প্রতিফলিত হয়েছে চেরানের কবিতায়।প্রেম, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সাথে মিশে গেছে সমুদ্রতটের রক্তাক্ত বালি,মর্টারের ধোঁয়া আর বুলেটের দাগ। বর্তমানে কানাডার উইন্ডসর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন চেরান। ‘কানাল বারি’,’মীন্দুম কাদালুক্কু’,’কাদাত্রু’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
রুদ্রামূর্তি চেরানের কবিতা
আপোক্যালিপস
আমরা বেঁচে থাকতেই আপোক্যালিপস
দেখে নিয়েছিলাম। মৃত মানুষের পায়ের
নীচে কুঁকড়ে যাচ্ছিল পৃথিবী।
একটা ঝড় ছিঁড়ে ফেলছিল লাশগুলিকে
শিউড়ে উঠছিল রাত,ভেতরে বাইরে
সবকিছু পুড়ে যাচ্ছিল আগুনে
শেষ বন্যা আমাদের ছেলেমেয়েদের টেনে
নিয়ে গিয়ে আগুনের ওপর ছুঁড়ে ফেলছিল
খুব তাড়াতাড়ি মরে গিয়েছিলাম আমরা
প্রিয় মানুষগুলির অসহায়,ফ্যাকাসে মুখের
দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
মরে গিয়েছিলাম আমরা
আগুনে পুড়তে পুড়তে
একটা মেঘের দলার ভেতর ঢুকে পরেছিলাম
কাফকা তাঁর নিজের লেখাগুলি
পুড়িয়ে যেতে পারেননি
কিন্তু শিবরামানি পেরেছিল
আকাশের মাঝখানে পুড়ে গিয়েছিল ওঁর কবিতা
যারা এখন কবিতা লেখে
তারাও আর বেঁচে থাকতে পারেনা।
আমরা সবাই মরে গিয়েছি
আমাদের গল্পগুলি বলার জন্যও কেউ বেঁচে নেই
শুধু একটি ভাঙাচোরা,রক্তাক্ত দেশ পড়ে আছে
কোন পাখিও আর উড়বে না এখানে
যতক্ষণ না আমরা ফিরে আসব।
একটি স্বপ্নের খোঁজে
একটুকরো স্মৃতি,
খুব ভোরে দেখা একটি স্বপ্নের স্মৃতিঃ
সাদা পৃষ্ঠাগুলিকে দলা পাকিয়ে
ছুঁড়ে ফেলছিলাম আমি
যেগুলিতে হিজিবিজি করে
কয়েকটা কবিতার লাইন
লেখা ছিল
কাগজের দলাগুলি
একসাথে জুড়ে গিয়ে
একটি কফিনে পরিণত হল।
একটি কাগজের কফিন।
কফিনটি একটি দেশের
পতাকা দিয়ে মোড়া ছিল
আমার ঠিক খেয়াল নেই কোন
জন্তুর ছবি আঁকা ছিল কিনা পতাকাটায়
কোন পাখি,কোন ফুল
কিম্বা কোন রঙের ছিল পতাকাটি
খুব আবছা,ধেবড়ে যাওয়া
একটি ছবির মত ছিল
আমার স্বপ্নটি
কেউ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল না
একা একাই কফিনটা
চুল্লির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল
ধড়হীন,মুন্ডুহীন
অনেকগুলি পা
কফিনটার পেছনে হেঁটে আসছিল
তীব্র অস্বস্তির ভেতর
আমি ঐ কফিনটার ফিকে হয়ে আসা
স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠলাম
চুল্লির আগুনেও যেটা পুড়ে যেতে চায়নি
তারপর একটা দিন শুরু হল
ঘোলাটে আকাশ,
কুয়াশায় জড়ানো বাড়িঘর
বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া রাস্তাঘাট
আর বিড়বিড় করতে থাকা একটা বুড়ো গাছ
যেটায় তখনো নতুন পাতা আসেনি।
রজিনি
আর কিছুক্ষন পর
সূর্য ডুবে যাবে
অন্ধকার নেমে আসবে
ওরকম অন্ধকার আগে কখনও দেখনি
ওরকম একটি রাত
আকাশের চাঁদ খুন হয়ে যাবে
আগুনে পুড়ে যাবে তারারা
শুধু ছাই মাখা একটি রাত
অন্ধকার নেমে আসার আগে
তুমি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইবে
একটা ছোট টর্চলাইট কিম্বা
একটা মোমবাতি নিয়ে ফিরতে চাইবে তুমি
আম্মা,
আজ ঘাতকরা দক্ষিণদিক থেকে আসবে
খুব তাড়া আজ ওদের
আজ ওরা রাইফেল আর
পাঁচটা বুলেট নিয়ে আসবে।
তুমি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর
সূর্যের শেষ আলো
তোমার ছায়াটাকে দেওয়ালে ঠেসে ধরবেঃ
আর তোমার হাতদুটো
আরও অনেক উঁচুতে উঠতে উঠতে
দিগন্তরেখাটাই পার হয়ে যাবে।
চেম্মানি
মুঠোভর্তি জীবন আর মৃত্যু নিয়ে
রাস্তার দিকেই ছুটে যাচ্ছিল বাতাস
ব্রিজটা পার হতে গিয়েই
থমকে দাঁড়ালো সে
আসলে বাতাস ঐ দিনগুলিকে চিনত
যখন ব্রিজের নিচের জল
নিল,সবুজ আর লাল আলোর
ইশারায় রঙিন হয়ে উঠত।
বৃষ্টির রাতগুলিতে
সমুদ্রের মত একটা জলের চাদর
লেকের ভেতর ঢুকে পড়ত
ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল একজন মহিলা
হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যেতেই
তার কোলের বাচ্চাটা জলে পড়ে গিয়েছিল।
আর নিজের বিছানাটাই
বুড়ো লোকটার লাশটানা গাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
বৃষ্টির পরে ভেজা হাওয়ায়
পুরো রাস্তাটাই একটা গোরস্থান হয়ে উঠেছিল।
সবাই চলে যাওয়ার পর
কুকুরের কান্নায় ভরে যাচ্ছিল
ফাঁকা গ্রামগুলি
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে
এইসব হাজার হাজার গল্পের ভার সহ্য করে
আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল ব্রিজটা
ব্রিজের নীচে
পাঁকের ভেতর পুঁতে রাখা খুলি আর হাড়গোড়গুলি
ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল
শুধু মিথ্যা গল্পে ভরে যাচ্ছিল বাতাস।
সন্ধ্যা এগিয়ে আসছিল
গলতে গলতে সোনা হয়ে যাচ্ছিল সূর্য
সবকিছু টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল
একটি মিথ্যা ছবি বারবার বলছিল
সবকিছুই এক,
কোথাও কোন পার্থক্য নেই
পায়ে শেকল পড়েই
আমাদের কাছে এসেছিলেন শান্তির দেবী
সবকিছু মুছে দিচ্ছিলেন তিনি।
তবু সমুদ্রের ধারে কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে
একমুখ হাসি নিয়ে পাহারদারটা জেগে উঠল।
লোকটার পাশেই আমি একটা রাক্ষসের মুখ দেখলাম
যে আমাদের দেশের সবকিছু বেচে দিচ্ছিল
আলো,বাতাস,সমুদ্র সবকিছু
হাঁ করে গিলে নিচ্ছিল আমাদের চাষের জমি,আবাদ
তাল গাছের মত লম্বা সাইনবোর্ডগুলির ওপর
আরও কয়েকটা মুখ গজিয়ে উঠল হঠাৎ
চেম্মানির গণকবরটা মোবাইল ফোনের
বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল
আর ব্রিজটা,হাজার হাজার গল্পের
ভারে
শক্ত হতে হতে
চোখের নিমেষে ভেঙ্গে পড়ল একসময়।
ভাষান্তর
ঃ শৌভিক দে সরকার
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন