সুমন গুণের সঙ্গে
কথাবার্তায় তুষ্টি ভট্টাচার্য
তুষ্টি ভট্টাচার্য: তোমার অকপট উত্তরে এটুকুই বলব , তুমি সৎ । এবার
তোমার বইয়ের কথায় আসা যাক । এ পর্যন্ত তোমার কটি বই প্রকাশিত হয়েছে ও কি কি ? আমার ধারনা , প্রত্যেকটা বই
প্রকাশের আগে অনেকখানি প্রস্তুতির দরকার হয় , বিশেষ করে প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে । তোমারও কি
সেরকমই হয়েছিল ? নিজের প্রথম বই , যে কোন লেখকের
কাছে তার প্রথম সন্তানের মত , বেশি আদরের । তোমারও কি তাই নাকি কোন নির্দিষ্ট বইয়ের ওপর
বেশি টান আছে তোমার ?
সুমন গুণ : হ্যা, যে-কোনও লেখার ক্ষেত্রে আমি অবধারিত
ভাবে সৎ। এই সাক্ষাৎকার যেহেতু আমি আমার লেখালেখির-ই একটা অংশ বলেই মনে করছি, তাই
বানিয়ে তোমায় কিছু বলতে পারবো না।
বই তো
অনেকগুলোই হলো। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে শেষ তিনটি
বই বেরিয়েছে : ‘অভিমতহীন’, ‘একটি আহত রূপকথা’,
‘বান্ধবনগরে বাড়ি’ । অনেকদিন আগে প্রমা থেকে বের হয়েছিল ‘সোমবার, আত্মীয়স্বজন’ নামে বইটি। তখন আমার কোনও প্রকাশক ছিল
না। সুরজিৎ ঘোষ করে দিয়েছিলেন। সুরজিৎদার মতো মেধাবী আর বর্ণময় প্রকাশক এখন আর
নেই। এই বইটির প্রতি আমার অনুরাগ কোনওদিন কমবে না। বইয়ের কবিতাগুলো খুব সংযত অথচ
প্রসারণশীল বিন্যাসে লেখা। আমি যেভাবে লিখতে চাই। একটা দিচ্ছি, দেখ :
দুপুরের বাড়ি, রোদ দেয়ালে ও ইষৎ কার্নিসে
দোতলায় গ্রিল, ছোটো বারান্দায় অসম্পূর্ণ চেয়ার, সবুজ
শাড়ি ও অচরিতার্থ
ফ্রক
ঝুলছে, দরজা সামান্য ভেজানো
আমার অনেক বন্ধু, এখনও, খুব আবেগ নিয়ে বইটির কথা বলে।
তবে প্রথম বইয়ের আমন্ত্রণ তো আমরণ থাকে। আমার প্রথম বই, আগেই জানিয়েছি তোমায়, অমিতাভ গুপ্ত করে
দিয়েছিলেন সেই নব্বইয়ের শুরুতে। ‘কলি, নুনদুপুর’ নামে এই বইটির কবিতাগুলো
প্রায় পুরোটাই ভেতরের দিকে বুঁজে থাকা। তখন ঐ ঘরানায় আস্থা ছিল। এখন নেই বলব না,
কিন্তু নানা কারণে আমি একধরনের স্বচ্ছতার দিকে ক্রমশ সরে এসেছি।
তুষ্টি : আচ্ছা পুরস্কার , মানপত্র বা কোন প্রতিষ্ঠান - এরকম কিছু কি কোন
লেখক বা কবির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে ? তুমি অনেকদিন এই জগতে আছ , কত সম্ভাবনায় ভরা
কবি-লেখক হারিয়ে গেছেন , বা তাদের কথা কেউ
জানতেও পারে নি , এমন নিশ্চই দেখেছ
। এঁদের ক্ষেত্রে হয়ত ওই পুরস্কার কিছুটা পরিচিতি দিতে পারত । আবার দেখা গেছে
যোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও সংঘের জোরে কেউ কেউ কিছু জুটিয়ে নিচ্ছেন । তুমি কি ভাব
বা এরকম কিছু কি দেখেছ তোমার লেখক-জীবনে ? তোমার ঝুলিতে আজ পর্যন্ত কটি পুরস্কার রয়েছে ?
সুমন : পুরস্কারের মধ্যে যে নানা জটিল অন্তর্ঘাত
থাকে, তার ধারাবাহিক ইতিহাস তো আমাদের জানা। পুরস্কার তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে তো আলো
আবশ্যই দেয়। তার নানা সুফলও আছে। পুরস্কৃত লেখকের কাজ আমাদের নজরে আসে। তা যদি
সত্যিই নজর কাড়ার মতো হয়, তাহলে তো সেটা সব দিক থেকেই স্বাস্থ্যকর। তা নাহলে
কিছুদিন পরে সেই পুরস্কারের কথা লোকে এমনিতেই ভুলে যাবে। এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই।
আমি আপাতত কৃত্তিবাস পুরস্কার এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
পুরস্কার কব্জা করতে পেরেছি!
তুষ্টি : আমার আগের প্রশ্নে সংঘের কথা যখন এলোই , তখন বলি – এই গ্রুপবাজি নিয়ে
তুমি কি ভাব ? একজন প্রতিষ্ঠিত
কবি বা লেখকের তাঁর নিজস্ব গ্রুপ বা তাঁবেদার তৈরী হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা বলেই
দেখা হয় । কেউ কারুর ভালো সহ্য করা তো দূর , কিভাবে একে অপরকে হেয় করা যায় , তারই নোংরা খেলা
চলে । এভাবে কি সাহিত্য হয় ? তুমিও কি কোন গ্রুপে আছ নাকি তোমারই নিজস্ব গ্রুপ আছে
অলিখিতভাবে ?
সুমন : শোনো, বাংলা ভাষার দুজন নামি কবি বুদ্ধদেব বসু আর বিষ্ণু দে। কবিতা ও জীবন সম্পর্কে এই দুজনের ভাবনার ধরন ছিল একেবারে আলাদা, আর এই
ব্যবধান তাঁদের দুজনের সম্পর্ক পার হয়ে ডানা মেলেছিল তাঁদের অনুরাগীদের মধ্যেও।
বুদ্ধদেবের অনুরাগীরা সকৌতুকে ধরা পড়তেন ‘বৌদ্ধ’ অভিধায়, আর বিষ্ণু দের গুণমুগ্ধরা
পরিচিত ছিলেন ‘বৈষ্ণব’ নামে। তো এই ধরনের ‘সংঘ’ সারা পৃথিবীর সাহিত্যেই ঘটেছে। এটা
হয়েই থাকে। পারস্পরিক তিক্ততাও তৈরি হতে পারে। বুদ্ধদেব-বিষ্ণু দে-র মধ্যেও
হয়েছিল। বলতে পারো এখন এটা বেড়েছে। তার
নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণও আছে। তাছাড়া লোকসংখ্যা বেড়েছে, কবি-লেখকদের
সংখ্যাও তো একই সঙ্গে বাড়ছে। আবার রেষারেষির জায়গাও তো বেড়েছে। ফেসবুক-এর মতো সুলভ
মাধ্যম আমাদের মধ্যে যোগাযোগ যেভাবে খুলে দিয়েছে, তার ফলে কিছুই তো আর গোপন থাকছে
না। আমি অবশ্য কোনও তুচ্ছ প্রতিক্রিয়ায় একেবারেই সাড়া দিই না। এটা তুমি জান। এখন
একটা ব্যাপার হয়েছে, যে-কেউ যা খুশি তোমার সম্পর্কে ফেসবুক-টেসবুকে বলে দিতে
পারছে। বলে, নিজে কিছুটা আলো পেতে চাইছে। চেনা কারও নামে কিছু বললে নিজেকেও কিছুটা
হলেও চেনানো যায়। কলকাতা থেকে তিনসুকিয়া --- সর্বত্র এই ধরনের আকাট আর অণ্ডকোষহীন
পরজীবীরা ছড়ানো। আমার শুভানুধ্যায়ীদের কাছে এদের কীর্তির খবর পাই মাঝে মাঝে। আমার
নিজের কোনও সংঘ নেই। তবে আমার বন্ধুরা, শুভানুধ্যায়ীরা,
অনুরাগীরা এঁদের সমবেতভাবে যদি তুমি একটা সংঘের আকার দাও, দিতে পারো।
তুষ্টি : শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষকে তুমি ‘গুরু’র সম্মান দাও বলে
শুনেছি । ওনার প্রত্যক্ষ প্রভাব কি তোমার লেখায় এসেছে ? কথায় বলে শেখার
কোন বয়স নেই , ওনার থেকে তুমি
কি শিখেছ বা শিখছ এখনও ? ওনার প্রভাব কি
তোমার লেখায় এসেছে কোনভাবে ?
সুমন : বোধহয় ভুল
শুনেছ। অত মহার্ঘ একজন মানুষকে ‘গুরু’ বলে মানার ধৃষ্টতা অন্তত প্রকাশ্যে আমি
কোনওদিন দেখিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। হ্যা, এটা সত্যি যে শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে প্রতি রবিবার যে দরাজ আড্ডা বসে, আমি দু-দশক ধরে সেই আড্ডার নির্ভুল সদস্য। স্যারের বাড়ির আড্ডার বৈশিষ্ট্য হলো যে-কেউ যে-কোন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারেন। সার্থক আড্ডার ধরন-ই তো তাই। আর আমাদের দুর্লভ কিন্তু নিঃশব্দ প্রাপ্তি হয় যখন স্যার আমাদের কথায় তাঁর কথা মেশান। ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটে চলে, আড্ডার নিজস্ব নিয়মেই সেটা হয়, কিন্তু এই স্বাভাবিকতার যে-অতিরিক্ত ঐশ্বর্য, তা আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনের ভাঁড়ারে গোপনে তুলে নিতে থাকি।
আমি এই আড্ডার উদ্দীপনায় একটা কবিতা লিখেছিলাম, ‘রোববারের আড্ডা’ নামে সেই কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম :
জয়দেব বলেছিল
শঙ্খগতি, প্রতি রোববার
সকালে ঈশ্বরচন্দ্র
নিবাসের দিকে আমাদের
উদ্দেশ্যমূলক চর্চা,
কীসের উদ্দেশ্য? কোনওদিন
প্রকাশ্যে বুঝিনি,
কেউ দেখেছি নতুন লেখা নিয়ে
ছন্দের দম বুঝে নিতে
গেছে, কবিসম্মেলনে
নেবার অসম্ভব দায় কারও
কাঁধে, কেউ বছর বছর
ঠায় বসে আছে হয়ত একযুগ
পরে
একটি নিঃশব্দ লেখা
পাবে ব’লে।
যারা রাজনীতি করে,
তারা রোববার প্রকাশ্যে আসে না।
আমরা তো যাই শুধু
আড্ডার হল্কা নিতে, আর
আমি তো স্বেচ্ছায় আজ
বাংলার বাইরে, কলকাতার
খাতায় নামটা যাতে থাকে
সেই লোভে উড়ে আসি।
কিন্তু না, স্যারের কাছে কিছুই শেখা হয়নি আমার। ছাত্র হতে হলেও যোগ্যতা লাগে!
আর শঙ্খ ঘোষের কবিতা সময়ের খর চলাচল ধারণ করে স্বগত হয়ে
ওঠে। তার অন্য ঐশ্বর্য আছে। কিন্তু আমি
যে-প্রবণতায় কবিতে লিখি, তার সরণিটা অন্য।
ফলে কবিতার ক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের প্রভাব
অর্জন করার সুযোগ আমার নেই।
-----------------
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন