সুমন গুণ : আধুনিক কথাটার মধ্যে অনেক তাত্ত্বিক আর মস্করাময় জটিলতা আছে। আমি সেসবে ঢুকছি না। তুমি মনে হয় বাংলা কবিতার এই সময়ের কিছু প্রবণতার কথা বলছ। এটা ঠিক যে নানা বাঁক আর বিপন্নতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এখন আমাদের কবিতা আরও আত্মমর্যাদাময় হয়ে উঠেছে। কতরকমভাবে লেখা হচ্ছে এখন! নিজের কথা নিজের মতো করে বলার তাগিদে অনেকেই কবিতালেখার চালু সব প্রকরণ ভেঙে দিচ্ছেন। পাঠকের দিকে তাকিতে কবিতাকে স্বাদু আর মশলামধুর করে তোলার ইচ্ছের বাইরে নিজেকে রাখতে পারছেন অনেকে। এটা খুব বড়ো ব্যাপার। লেখার কবজি আছে বলেই তাঁরা ‘ব্যাকরণ মানি না’ বলার স্পর্ধা দেখাতে পারছেন। এই যেখানে তুমি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছ, সেই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এমন নানা নিরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত । আমি তাঁদের অনেককেই চিনি। তাঁদের লেখার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস আছে। আমি কারও নাম করব না। আমরা তো এর আগেও নানা নিরীক্ষাপ্রবণ কবিতা পড়েছি বাংলায়। কত আন্দোলন হয়েছে কবিতা নিয়ে। বাংলা কবিতার বিকাশে এই সব আয়োজনেরই ভূমিকা আছে। ROBERT LYND তাঁর ‘ AN ANTHOLOGY OF MODFRN VERSE’-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবিতা আমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার জীবনেই ফিরে আসতে শেখায়। একই সঙ্গে তাঁর সমান শিহরণ-জাগানো ভাষ্য ছিল, দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনটি না ঘটলে প্রথমটির কোনও মর্যাদা নেই। এই সময়ের বিভিন্ন কবির লেখা পড়ে কথাটির মানে আমি টের পাই। এই প্রসঙ্গে তুষার চৌধুরীর একটি কবিতা মনে পড়ছে। কবিতা সম্পর্কে নিজের দর্শনটি সরলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তুষার চৌধুরী তাঁর ‘কবিতা লেখার আগে’ নামে একটি কবিতায়। বললাম বটে সরলভাবে, কিন্তু কবিতাটি পড়লে টের পাওয়া যায় একটি সচেতন ও মননশীল ধারণা কবিতাটিতে আকার পেয়েছে। কবিতা যে গালগল্প কান্নাকাটি স্মৃতি বা বিস্মৃতি নয়, শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই যে কবিতার বাস, একথাটা অবলীলায় বলেছেন তিনি। বলেছেন যে, কবিতা:
গর্ভিণী নারীর মত নিদ্রাতুর নয়
বিষধর নাগিণীর মত তার ফণা তুলে ধরে
এই সময়ের অনেক কবিতাও তো তাই, আমাদের সময়ের মতোই বিসর্পিল তার বিন্যাস। ঘুমপাড়ানি বাংলা কবিতার নিদ্রাতুর হর্ম্যের সুবিধে না নিয়ে যে-কবিতা বেতালা মাতাল কোন দিশাহীন টার্মিনাসে এসে অনিশ্চিতের পাদানিতে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। কবিতাকে নিছক প্রাতরাশ নৈশভোজ উরুর ইশারা হিশেবে ব্যবহার করেন যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে এই কবিতার ঘরানা ধারাবাহিকভাবে জয়ী হয়েছে।
তুষ্টি : এতদিনে আমরা তোমার প্যারিস ভ্রমণ নিয়ে অনেক কথা জেনে ফেলেছি 'দেশ' বা আনন্দবাজার থেকে। তবু যারা পড়েন নি , তাদের জন্য আবার কিছু বল । আর লন্ডনের কবিতা পাঠ নিয়ে তোমার বক্তব্য শুনতে চাই এখানে।
সুমন : প্যারিসের অভিজ্ঞতা নিয়ে যা লিখেছি তার বাইরেও অনেক কিছু আছে। হয়ত লিখবও সেসবও। এটুকু বলতে পারি, কবিতা যে এখনও অন্তত কিছু মানুষের কাছে অবলম্বনের মতো, সেটা প্যারিস আর লন্ডনে গিয়েও গিয়েও আমি বুঝেছি। প্যারিসের যে-পাবে গিয়েছিলাম বোদল্যেরের জন্মদিনে, সেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তরুণ তরুণীদের দেখে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে আমি টের পেয়েছি যে সৃজনশীলতার প্রতি মানুষের মনস্কতা আরও বাড়ছে। ঐ পাব যিনি প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর একটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আমি ‘বাক’ পত্রিকার জন্য তুলে দিচ্ছি। কবিতাটি তিনি তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে লিখেছিলেন, যিনি এখন সেই পাব সামলাচ্ছেন পুত্রকে নিয়ে। ঝকঝকে কবিতা। বাংলা অনুবাদে কবিতাটিকে আরও কাহিল না করে আমি পুরো কবিতাটিই তুলে দিলাম :
On top of you guitars
His blue eyes and smile
the night mingled with her hair
Each train forgot his station
The ebb and flow of the inland sea
Who drove my heart to the cause of his
made me like the shadows dog
we see lap night leftover glow
My Egyptian my mythical
When we bathe us again
at the port of Alexandria between these old ships
which sail burst gave the music
the top of the tallest pyramid
Licked by millions tourist gaze
Between The Light legends and songs
I bring you these words still wet with blood
These inhuman verses superhuman love
When love writing to his beloved poet
He loads his ink pen eternity
Then said Madam I just love you
and I would be grateful for noticing
লন্ডন অনেক বেশি কেজো শহর প্যারিসের তুলনায়। লেখালেখি নিয়ে আবেগও এখানে তুলনামূলকভাবে কম। তবে পশ্চিমের সব শহরই নানা কারণে নোংরা হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্যারিস। গলিতে দাঁড় করানো দুটো গাড়ির ফাঁকে, এমনকি অত্যুজ্জ্বল মেট্রো স্টেশনের কোণায় দাঁড়িয়ে দৈত্যাকার য়ুরোপীয়দের নির্বিবাদে হালকা হতে দেখে আমার প্রথম বিশ্বের নাগরিক সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা এমনিতেই ঘেঁটে গিয়েছিল।
তুষ্টি : কবিতায় গদ্য ভাবনা নিয়ে কী ভাব ? অথবা গদ্যে কবিতা ভাবনা কী আসতে পারে ? কবিতা ও গদ্যের মধ্যের সীমারেখা থাকা কী উচিত ?
সুমন : এখন নানা ভাষার লেখা আমাদের নাগালে। যে-কোনো ভাষার সাম্প্রতিক স্পর্শ নেবার অনেক সুবিধে। আমি নিয়মিত বিভিন্ন ভাষার লেখার খোঁজখবর রাখি। বাইরে গেলে সেখানকার সদ্যতম চর্চার ছোঁয়া নিতে চাই। এটুকু বলতে পারি, আমরা আমাদের লেখায় যেভাবে নিজেদের ধরে দিতে পারছি, সেটা সারা বিশ্বের লেখালেখির নিরিখেই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন