ঝিঁঝিরা... ডাক
শোনা যায়
(বই নিয়ে আলোচনা : 'ঝিঁঝিরা')
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
“আয়না কি শুধু চোখে দেখার জন্য রে পাগলা?” অবিকল জনপ্রিয়
ফিল্ম অভিনেতার গলায় কথাটা বলে তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে শুরু করলেন। সারা ঘরের
আয়নায় সিলিং থেকে ঝুলে পড়া স্যরেরা দুলে ওঠেন, পেন্ডুলামের মত দুলে চলেন।
গল্প হলেও সত্যি ছবিতে
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অভিনীত চরিত্রটি একটি শব্দ ব্যবহার করেছিল ‘শকিউমেন্ট্রি’ (Shockumentary)। মনে আছে?
ওপরের এই অংশটি পড়তে পড়তে ঠিক সেই শব্দটা মনে পড়ে গেছিল আমার। পাঠকের জন্যে এমনই
এক একটা বাক্যে, অংশে... ছড়িয়ে রয়েছে শক। ওই চেতনার শকটা দরকার। বাংলা গদ্য এবং
বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রচলিত গল্পগুলির মধ্যে সাহিত্যের এই ধারাটা ক্রমেই ম্লান হয়ে
আসছে। একটা ধারা হয়ে রয়ে গেছেন নবারুণ, থাকবেন। আর তারপরে সেই
নবারুণ আলোতেই কাঁচা নর্দমার পাঁক ঘাঁটার সাহস দেখাবেন কেউ কেউ। তবে এইরকম
শকিউমেন্ট্রি তৈরী করতে অনেকটা প্রয়াস লাগে... শ্রেফ অনুসরণ (বা অনুরূপ শব্দটি
দিয়ে আসে না)। অবশ্য শক শোনা মাত্রই চমকে যাওয়া বা নেতিবাচক প্রভাবের চিন্তায় সতর্ক হয়ে ওঠার
কিছু নেই। জীবনবিজ্ঞানের একাধিক পরীক্ষায় প্রমানিত, একাধিক প্রকারের থমকে যাওয়া
জৈব প্রক্রিয়া এই রকম হালকা শক দিয়েই আবার চালু করতে হয়। ওই শকটা প্রয়োজনীয় হয়ে
পড়ে সেই পরিস্থিতিতে।
বইটি যখন কিনেছিলাম, গল্পের বই
হিসেবেই কিনেছিলাম। তারপর পড়তে শুরু করলাম, প্রথম গল্প থেকেই। পড়তে পড়তে একসময় মনে
হ’ল... এখানে কোনও
সীমানা নেই। গল্প গিয়ে মিশেছে গদ্যে... গদ্য গলে রূপ নিয়েছে কবিতার... বয়ে গেছে এক
খাত থেকে আর এক খাতে। ঠিক জমির প্লটের মত মাপে মাপে গল্প নয়, এই লেখার প্রবাহ আছে।
একটা ভেসে যাওয়া আছে। যেমন ধরা যাক, এই অংশটি-
“সবাই এক এক করে নীচে নামছে। নামার পথটা ঘড়ির কাঁটার দিকে,
তাই বেশ সংকীর্ণও । আমাদের সূর্য দেখা হয়নি, কুয়াশার কারণে, মেঘের কারণে। আমরা
কুয়াশা দেখে ফিরছি এক এক করে। কুয়াশায় নেমে আসছি, মেঘে নেমে আসছি। নিজেদের মধ্যে
নেমে আসছি।”
এ কে পাঠক, গল্প বলে নির্দিষ্ট
আধারে রাখতে পারলে, সে তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বলব... আমি পারিনি।
এই রকম কথা-বাক্য-স্বপ্ন-অনুভবের
ভেলাতে ভেসে যেতে যেতেই ‘গানওলা’ থেকে ‘নামহীন রুহ্’... ‘নামহীন রুহ্’ থেকে ‘খোয়াব খেকো’... ‘খোয়াব খেকো’ থেকে ‘শেষ বলে কিছু নেই’ অবধি ভেসে যেতে হবে... বইয়ের পাতা উলটোতে উলটোতে। এমন কি, এক একটা লেখা (সব
কটাকে আদৌ গল্প বলব কি না, সেই নিয়ে আমি নিজেই দ্বিধাভক্ত) দেখলে, তার নাম করনের
মধ্যেও একটা শৈলীর স্পর্শ পাওয়া যায়। সেখানেও একটা বোধের প্রকাশ, আর একটা প্রশ্নের
জন্ম দেওয়ার প্রয়াস দেখতে পাই। চিৎকার... যাকে ইংরেজী তে বলা যায় ‘Scream’। ‘চিৎকার’ গল্পটা পড়তে পড়তে একসময় তো
সত্যিই শিল্পী এডভ্যাট মুঙ্ক (Edvard Munch)-এর 'The
Scream ' কে জীবিত হয়ে উঠতে দেখা যায় বইয়ের পাতায়!
"প্রতিটা খবরের কাগজ বেঁচে
থাকে একদিনের জন্য। সকাল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে তার যৌবন, তারপর বেশ্যার
প্রৌঢ়ত্ব।"
ঠিক এই ভাবেই, চিন্তার এক
একটা স্তর প্রত্নতাত্ত্বিকের মত খনন করা হয়েছে এক একটা গল্পে। লেখিকা, চেয়েছেন,
নিজের দেখাটাকে ‘একজিবিট’-এর মত ‘স্পেসিমেন’ তুলে তুলে রাখতে পাঠকের সামনে। যাঁরা দেখতে চান, এবং এইরকম দেখার ইচ্ছে নিয়েই
গল্পের মধ্যে জীবনকে খোঁজার চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছে এই স্পেসিমেনগুলো খুব একটা
হেলাফেলার জিনিস বলে মনে হবে না। খুব গম্ভীর, গভীর, মননশীল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের
ধারে কাছে না গিয়েও জীবন দর্শনের জাল যে কি সুন্দর কথা দিয়ে বোনা যায়, তা এমন লেখা
পড়লে আবার করে চিনতে পারি... এইখানেই ভাল লাগা লেগে থাকে। এই স্তর থেকে স্তরে
বিচরণ করতে করতেই কখনও প্রশ্ন আসে -– মা বলেই ডাকে?কখনও ক্যামেরা টা ক্লোজ ইন হ’তে দেখায় -- কাঁচের
দরজার ওপারে ‘বিজলি গিরিয়ে’ আট বছরের রানির চোখ টেনে আটকে রেখেছেন চল্লিশজন
শ্রীদেবী...
আবার কখনও এক শিক্ষক তার ‘সূর্য’ কে বোঝায় –-
“আমরা হচ্ছি বাষ্পের মতো, সবসময় থিতু হয়ে যাই... থিতু হলে কী
হয় জানিস? তরল হয়ে যাই আমরা, কাঁচের গায়ে, ঘাসের গায়ে জমি যাই, আর ওড়া হয়ে না
আমাদের। তাই যখনই দেখবি বাষ্প জমছে, উড়িয়ে দিবি, ফুঁ দিয়ে সব উড়িয়ে দিবি।”
সত্যিই বইটির সব ক’টা লেখা ‘এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম’ বলা যায় না। কারণ এক
নিঃশ্বাসে পড়ার নয়... পড়তে পড়তে কিছুক্ষন নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মত লেখা। বাক্য
সাজানোর মুনশিয়ানা এবং গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বিন্যাশও বেশ চোখে পড়ার মত... কিছু
বাক্য রীতিমত উদ্ধৃতি দেওয়ার মত সুন্দর। তবে পড়তে পড়তে কিছু জিনিস বোঝা যায়, যেমন – এক একটি লেখার সময় কালের
মধ্যে, বা লেখিকার ভাবনার পরিণতরূপের মধ্যে একটা চড়াই-উতরাই আছে। সে ভাল কি খারাপ
তা জানি না, তবে একটা গল্প থেকে আর একটা গল্পে যেতে গেলে এটাও হয়ত সচেতন পাঠককে
ভাবাতে পারে। আবার এও বলব, বাংলা ভাষায় ডায়ালেক্ট-এর প্রয়োগ কিংবা সাব-অল্টার্ন
ভাষার ব্যবহার যেখানে যেখানে... সেখানে আর একটু সচেতন ভাবে তা ব্যবহার করলে হয়ত
অনেক বেশি রক্ত-মাংসের হয়ে উঠত চরিত্রগুলো।
যেখানে, একদিকে বেশ প্রতিষ্ঠিত
নামগুলোকে ব্যানার করে বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে বাংলা ছোটগল্পকে সরল করতে করতে
মেরে ফেলা হচ্ছে... সেই সময়ে মনে রাখার মত একটি প্রয়াসগুচ্ছের সম্ভার এই বই। ভাল
খারাপ বলে আদৌ কোনও সৃষ্টিতে শীলমোহর বসানো যায় কি না আমার জানা নেই। আর তার উপায়
থাকলেও, আমার সীমিত ক্ষমতার বাইরে। আমি কেবল আমার ভাল লাগা, আর আমার দেখা গুলো
সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।
আর হ্যাঁ, এত কথায় ভাসতে ভাসতে
আসল কথাগুলোই বলা হয়নি... যে বইটির কথা বলছি এতক্ষণ, বইটির নাম ‘ঝিঁঝিরা’... লেখিকা অলোকপর্ণা
(সৃষ্টিসুখ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত, মূল্য - ৯৯ টাকা)।
পুনশ্চঃ বার বার ‘পাঠক’ শব্দের ব্যবহার
করায় পাঠিকারা রুষ্ট হ’লে... আমি আন্তরিক ভাবে মার্জনা চাইছি। ভাষার মধ্যে এই
বৈষম্য রয়েছে... তার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে এই ক্ষেত্রে (শিকার হ'তে হয়েছেও
বলা চলে)।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন