তুমি
ইস্রায়েলের হিব্রু ভাষার কবি অরিট গিদালি-র কবিতা
অনুবাদ : অর্জুন
বন্দ্যোপাধ্যায়
ইস্রায়েলের
হিব্রু ভাষার এই সময়ের অন্যতম কবি অরিট গিদালি-র জন্ম ১৯৭৪-এ। গিদালি-র অনুবাদক
মার্সেলা সুলক
গিদালি-র কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘পারিবারিক বৃত্তটা হ’ল মঞ্চ, আর সেখানে এক
মানুষের ব্যক্তিক মাপ-দণ্ডে মঞ্চস্থ হচ্ছে এক জিওপলিটিক্যাল নাটক।’ কিছুদিন আগে সুলককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গিদালি বলছেন, ‘আমি জন্মেছিলাম অক্টোবর যুদ্ধের পর [Yom Kippur war, October 1973]। আমার বাবা বহু যুদ্ধে লড়েছেন। চার
সন্তানের মা আমি। ইস্রায়েলি এই ড্যান্স অফ ডেথের আমিও একটা অংশ। এমন একটা সমাজের আমি
অংশ, যে সমাজ হিংসায় দ্বন্দ্বে নিজেকে জড়িয়ে রাখছে। যা আমার অস্তিত্বের উৎকণ্ঠাকে
প্রভাবিত করে। আমি বুঝতে পারি, গৃহের ভেতর, তার পবিত্রতা এবং সৌন্দর্য আর এই
বাইরের হিংসা, এই দুয়ের মধ্যে একটা বিরাট গ্যাপ রয়েছে। আমার অসহায় লাগে নিজেকে।
আমি লজ্জিত, এবং অত্যন্ত দুঃখিত এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য। এই অনুভূতি আমার
কবিতায় গভীর শেকড় তৈরি করেছে।’ ওঁর কবিতায় শব্দ-সমূহ
নিয়ে এবং তার অর্থের রেঞ্জ নিয়ে নিরন্তর খেলতে থাকার মধ্যে সাধারণ একটি শব্দের আচরণটাই
পালটে যায় বহু-রৈখিক এক অভিজ্ঞতা-প্রণালির ভেতর। গিদালি হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাইকোলজির স্নাতক এবং বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এ
স্নাতকোত্তর। তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর অধ্যাপিকা। প্রকাশিত
কবিতার বই দু’টি— ‘টোয়েন্টি গার্লস্ টু এনভি মি’ [২০০৩] এবং ‘ক্লোজিং-ইন’ [২০০৯]। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘নোরা দ্য মাইন্ড রিডার’ [২০১১]। এ’ মাসের ‘অন্য ভাষার কবিতা’য় গিদালির দ্বিতীয় বই ‘ক্লোজিং-ইন’ থেকে কয়েকটি কবিতার ভাষান্তর
করলাম।
নোট
প্রেমিক, জেগে উঠছে
শরীর
উষ্ণ হচ্ছে তার ওপর
মিশে
যাচ্ছে মাংসে আর দুধে
সংস্
টু এ ডেড উওম্যান
তুমি
তুমি
১.
লিফ্টের
ভেতর যখন জেগে উঠছ তুমি, মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখোনি
বিছানায়
শুয়ে পড়ছ যখন ছড়িয়ে, মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখোনি
যখন
তুমি জানলা খুলছিলে, মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখোনি
মাথা
ঘোরার ওষুধ খাচ্ছ যখন, মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখোনি
যখন
জানলার ধারে দাঁড়িয়েছ, মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে রাখোনি
বিছানায় শুয়ে। মেয়ে, তোমার। সময়ে অসময়ে কেঁদে উঠছে ঘুমের ভেতর থেকে।
ভিড়
জমে যাচ্ছে লোকের। ওর লেপের চারপাশ ঘিরে মাথা দোলাচ্ছে তারা।
তার
শৈশবের সমস্ত ক্রম-পরিবর্তনের মতো মাথা দোলাচ্ছে, ভিড় ক’রে আসছে ওর চারপাশে
মেঝের পর মেঝেতে ছড়িয়ে জেগে উঠছ তুমি
একটা
গিফট্ প্যাকের রিবনের মতো
নাভি-কেন্দ্র
ভেসে ভেসে যাচ্ছে তোমার কাছে
যে
গিফট্ কখনও দেওয়াই হ’ল না
২.
ওর
ভেতর তোমার নিজের গন্ধকে চিনতেই পারোনি। না পেরে ‘হেল্প’ ব’লে ডেকেও ওঠোনি তুমি।
যে
মাটি ঢেকেছে তোমার শরীর, ছড়িয়ে দাওনি। ওর খেলার বাক্সে ভ’রে দাওনি সে মাটি।
সিঁড়ির
রেলিং ধরার মতো ওকে ধরতে চেয়ে একটা শব্দও তো ছেড়ে দাওনি ওর জন্য
৩.
মৃত্যুর
তিক্ততার জন্য সুরগুলো কিন্তু প্রয়াত হয়নি কখনও,
লেফাফার
ডানা কাঁপছে মেঝেতে
জগতে ‘ধপ্’ শব্দে প’ড়ে যাওয়া শরীরের মতো নয়,
অধোভুবনের
রহস্যভেদ করতে চাইছে তার ভরবেগের পুণ্যে
মৃত্যুর
তেতো স্বাদ পৃথিবীর সহজ প্রশ্নগুলোকে মেরে ফেলতে পারেনি কখনও
কোন্
পেট থেকে আমি বেরিয়েছি মা, শোওয়ার আগে মেয়ে জানতে চাইছে তোমার কাছে
কোথায়
সেই পেটটা, কী আছে এখন সেই পেটে।
তোমার
মেয়ে
১.
কালো
চোখ
মনে
করো চলে গেছ কিভাবে, মনে করো ফেরোনি
সুভেনিরের
মতো ওর ছাত্রকূলের মধ্যে তুমি শুধু ছেড়ে গেছ রাস্তার রঙ
২.
দ্যাখো,
কিণ্ডারগার্টেন থেকে যে ফিরলো, সে কে?
ওর
ড্রইং-এর কাছে ঝুঁকে দেখছি, আমি তো আঁকা নেই সে খাতায়
পাতলা
জরি বানাবে ব’লে প্লেটের ওপর ধানের দানা
ছড়াচ্ছে মেয়ে
এবং
একটি শব্দকেও সরতে দিচ্ছে না কিছুতে
আমাদের
মাঝখানে যে হাওয়া, চলাচল, এক মুহূর্তের জন্যেও ভ’রে না উঠুক
ভ’রে না উঠুক এই নিরাপদ অঞ্চল
৩.
জানলা
থেকে তুমি দেখতে পাচ্ছো খেলার মাঠটাকে
প্রাইমারি
রঙে আঁকা
কতটা
সহজ আর সুন্দর সে রঙ
ঘরের
কতটা কাছেই
৪.
মাঝেমাঝে
মনে হয়, শব্দের দুটো বর্ণের মতো যদি কাছে আসা সম্ভব হ’ত
স্বরবর্ণ
ছাড়া শুধু উচ্চারণ-চিহ্ন দিয়ে লেখা শব্দের মতো
কিন্তু দ্রাম্ শব্দে বন্ধ হওয়া দরজাকে শুধু
লুফে
নেয় ফ্রেম
হ্যাণ্ডেলটা
সোজা থাকে শূন্য রেখার মতো
এক ধাপ থেকে আরেক ধাপের মাঝখানে থাকা
সত্যের
অনন্য মুহূর্ত
যখন সুস্থিতি
ও সাম্যাবস্থায় যায়
সেটা তো
মিথ্যে
তোমার
বর
১.
ওর মন
যদি পেরিয়ে যাও তুমি, কি দেখবে আমি জানি না
ওর
জার্নালগুলো কবরখানার মতো বন্ধ আমার কাছে
রোজ সকালে ভীষণ কাজের এক গোলক নিক্ষেপ হ’ত তার দিকে
সময়
ছিল না, কিন্তু লুফে নিত
আর
পাঠিয়ে দিত সেই গোলককে তার কক্ষপথে
বায়ুতে
শরীর যতক্ষণ থেকে যায়, ওর বিশ্রাম ভাঙতো সেভাবে
২.
বেডরুমে
দু’টো বাক্স।
প্রথম
বিয়ের ছবি ওপরে। তার নীচে দ্বিতীয়।
একটা
ছবিতে ও ঝুঁকে আছে আমার অথবা তোমার দিকে
বাঁধা
আছে ওর লম্বা হাত দু’টো।
৩.
বাচ্চার
প্রথম লাথিটা
ওকে
প্রথম লাথির মতো উত্তেজিত করেনি
চোখে
আলো জ্বলছিল। নিভছিল।
শব্দহীন
সাইরেন যেভাবে ব্লিঙ্ক করে।
৪.
কখনও,
সকালে তোমার নাম ডাকা হয়।
তাড়াতাড়ি
কথা বলছি আমরা, দুর্ঘটনায় পা যাতে পিষে না যায় তোমাকে
এখন,
বেশিরভাগ সময়েই শুয়ে থাকছ তুমি, শান্ত,
যে
ঘরে ঝাঁট পড়েনি
তোমার
বাড়ি
১.
সিঙ্কে
ডিশগুলো একটার ওপর আরেকটা এমনভাবে প’ড়ে আছে, যেন একই ফুল
থেকে আসেনি এসব
কখনও
একটা স্বপ্ন নিজেকেই ঢেকে ফ্যালে, তোমার ছায়ার মধ্যে। কিন্তু তাকে দেখে শুধু
অন্ধকার বলেই ঠাহর হয়।
দিনের
কাজের শেষে যে অন্ধকার আসে।
একটা
পা ফেলা, আর তার মধ্যেই তুমি হারিয়ে গেছ বাড়ির হাত থেকে
ছাদের
রেলিং ধ’রে থাকা যে হাত
এরপর,
একেবারেই নিবিড়তা ছাড়াই
আবার
ফিরে আসছ
ঘরের
ভেতর।
২.
না,
হয়ত একমাত্র কবিতাই শুধু ভুলে যায়
তুমি
বরং এসো না। বাড়ির ট্যাপটাকে নষ্ট করার জন্য আর এসো না।
সেই
লোকটাকে আর কোনো নস্টালজিয়া দিও না যার জীবনটাকে চিমনী বানিয়ে দিয়েছ
এবং
আমার প্রেগন্যাণ্ট স্টমাকে আর ভূত পাঠিও না কোনো।
আর কোনো ড্যামেজের কারণ হয়ো না তুমি ; তোমার আমার
মধ্যে যা কিছু
তার
মীমাংসা আর হবে না কখনও।
মধ্যম পুরুষের ভাষার ক্ষত নিয়ে আমি লিখছি তোমাকে
যার
নতুন আর কোনো সুগন্ধ দেওয়ার নেই
র্যাচেল
আর লী’র অভিশাপ পুড়ছে আমার জিভে
এ’ তার অভিশাপ যে জানে না এদের মধ্যে সে নিজে কোন জন
তোমার
জয়
১.
রামধনুতে
সূর্য যে অয়েল পেইন্ট ঝালাই ক’রে দিচ্ছে
সে তো
জয় নয়। কত সহজেই ফেরৎ আসছে বল
যেন
পথে কোনো পাথর-টুকরো নেই
গড়িয়ে
নামছে ঢালু বেয়ে
সংলগ্নতা শুধু, হর্ষোল্লাস নয়।
শুধু
এক হা-ক্লান্ত মেয়ে
দু’পাশে ছড়াচ্ছে তার কৃত্রিম দু’ হাত
আর
বাড়ির পাশের খেলার মাঠ উপহাস করছে তাকে
মাঠের
দাবিদাওয়া নিয়ে
২.
আমি
আর কিছু লিখতে-টিখতে যাচ্ছি না বাপ্
এবার
উঠতেই হবে
যে
মানুষটা ঘরে ফিরেছে, রান্না চাপাতে হবে তার জন্য
ছোট্ট
মেয়েটাকে আনতে হবে স্কুল থেকে
নতুন জামা-কাপড়
কিনতে হবে
ফ্রক,
স্কার্ফ, স্কার্ট, টিউনিক
বোতাম
আটকাতে হবে জামার
আর
বিছানার চাদর আর আরও আরও বিছানার চাদর
অন্ধকার
নামবে শিগগিরি
অন্ধকার নামবে এখুনি
সাইকেল
চেপে বাচ্চারা চলে আসবে গেটের কাছে
হুড়মুড়িয়ে
ওদের ঢুকে পড়া ঘরের মধ্যে ফেটে পড়বে ফুটন্ত জলের মতো
এখান থেকে অনেক মাইল দূরে, তুমি বার্নারে পাত্র চাপালে
জল
ফোটার ভুরভুরি শব্দ শুনছ, যেন এ-ও এক জীবনের চিহ্ন
বাচ্চারা বলতে থাকবে সাইকেল নিয়ে কতদূর তারা চলে গেছিল আজ :
মিউনিসিপ্যাল
রোড ধ’রে, আরও দূরে যেখানে থেমেছিল,
শাখাবিন্যাস আর শাখাবিন্যাস,
গ্যাস
স্টেশন অব্দি আর আরও দূরে বৃদ্ধাশ্রমের কাছে, সোজা রাস্তা পর্যন্ত, পাশের রাস্তা
দিয়ে
উত্তেজিত
হয়ে পড়বে এসব বলতে বলতে।
এতদূর
ওরা যায়ই নি আসলে।
ওদের
জুতোর ধুলোই তো ব’লে দেবে সব।
একই সময়ে, ব্যালকনিতে হেলান রেখেছ তুমি
তোমার
বাড়ি থেকে পালানো পথে হাওয়া বইছে
একটা
হুইস্ল চলে যাচ্ছে সেই ফাঁক দিয়ে
শাখাকে
যে বিভাজিত করেছে পাতার থেকে
পাতাকে
করেছে ফল থেকে
মৃদু একটা শিস্
প্রায়
শব্দই নেই যার, এতো মৃদু
আর
সমস্ত কিছুর একটা ধ্বনি
এবং
এদের মাঝখানে এক দূরের কুহর
সবকিছুকে
ধ’রে রেখেছে যে এইখানে
ঋণ ও কৃতজ্ঞতা : মার্সেলা সুলক
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন