আবহমানের শোলোকগাথা
অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
“রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে, টিপটিপ
বৃষ্টির মধ্যে শূন্যতা নিয়ে থই থই ভেসে গেছি আমি। আমার কোনও বন্ধু নেই। স্বজন নেই।
ঈশ্বর নেই। পৃষ্ঠপোষক নেই। রাজনীতি নেই। আমি ঠিক স্বাভাবিক মানুষ নই। সতেজ যুবক
নই। গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা। গলা ছেড়ে গান গাইতে পারিনা। মস্তানের মতো দুরন্ত
গতিতে সব কিছু দুপকেটে ভরে নেবার কৌশল আমার আয়ত্বে নেই। অন্ধকারে নিসর্গদৃশ্যের
কিনার ধরে হাঁটি। নির্জনতা ভেঙে দূরে জেগে থাকে বিষণ্ণ ভাটিখানা। আমি মাতালের
কাঁধে হাত রাখি। আর লম্পটের চোখের জলে ভেসে যায় আমার করতল”...। এই ভেসে যাওয়ার পথ ধরে ধরেই একের পর এক দৃশ্যকল্প
জন্ম নেয়। একেকটা আলেখ্য তৈরী করে লোককথার শরীর। যেন কথকের অদ্ভুত আলখাল্লার ভেতর
থেকে একটা একটা করে উড়ে যায় জাদুপালকেরা যাদের নরম থেকে ঝরে পড়ছে ধানের গন্ধ, আলোর গল্প, ব্রতকথা আর পাঁচালীর সুর। গরুর গাড়ির ছইয়ের
ভেতর দুলে উঠছে লণ্ঠণ, চিলাপাতার জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে ফেউয়ের চীৎকার। ঢাকের শব্দে
অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে হস্তীযূথ। এক মুগ্ধ বালক এ সমস্তই তীব্র ক্ষুধায় লিখে
রাখছে অলিন্দে নিলয়ে। কেননা এরপরেই অবশ্যম্ভাবী শুরু হয়ে যাবে তার অভিশাপের জীবন। “কাঁধে
পাখি নিয়ে কিছুটা চাঁদের আলো ধার করে লম্বা নৌকোর ইশারায় বাক্সবন্দি কুয়াশার সঙ্গে
তোমাকে চলতে হবে বাকি আয়ুস্কাল”। সে হাওয়াকলের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পরতের পর পরত
খুলে চিনে নিতে শুরু করে “কাঠের ঘরবাড়ি, জড়ীবুটি বিক্রেতা, বান্ধবীর হাতব্যাগ,
পুরোনো চিঠির রূপকথা, শহরের নির্জন হাসপাতাল, আর ঝাউগাছের পৃথিবীতে বেড়াতে আসা
অসংখ্য সাদা বেড়াল”। আমরা সনাক্ত করতে পারি
এই কথককে...যিনি আদ্যোপান্ত এক নির্জন কবি আসলে, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ যার সামনে উবু
হয়ে বসে। তিনি কবি সুবীর সরকার। “ধানবাড়ি গানবাড়ি” শিরোনামে তাঁর ব্যক্তিগত গদ্যের
ছিমছাম সংকলন মুহুর্তে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় তাঁর ঔদাসীন্য আর নিঃসঙ্গতার
মুখোমুখি অসামান্য এক পৃথিবীর দিকে মুখ করে। যা স্থানিকতাকে অতিক্রম করে যেমন
ভুবনায়িত হয়ে ওঠে, আবার একই সাথে তাঁর শিকড়ের মাটির গন্ধটিকেও চিনিয়ে দেয়
মুগ্ধতায়।
কবি সুবীর সরকার তাঁর কবিতায় যেমন এক নিজস্ব ভাষা, আঙ্গিক, কথন ও
শব্দপ্রয়োগের অনন্যতায় স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন, গদ্যকার সুবীর তাঁর সাথে পাশাপাশি
হাঁটেন হাত ধরাধরি করে। কবিতা আর গদ্য কোথায় মিশে যায়, কোথায় পরস্পরকে জড়িয়ে আবার
স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে......সেসব বিচার না করেই এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিতে হয় গ্রন্থটি। তীব্র এক মায়ায় জড়িয়ে যেতে হয় এই
জনপদের নিসর্গ আর তার সাথে একাত্ম হয়ে
থাকা মানুষজনের সাথে। সেখানে সাতাশি বর্ষীয়া বৃদ্ধা “সাইটোল সম্রাজ্ঞী” নাচছেন। রাজবংশী মেয়েরা গাইছেন “ও জীবন রে,
জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে”। মজে যাওয়া ডোবা নালায় ফসফরাসের বাতি জ্বলছে নিভছে।
বাবুলাল বাঁশফোঁড় হাঁড়িয়ার নেশায় দুলে দুলে কুলিলাইন পার হচ্ছে। মদেশিয়া যুবতীর
খোঁপায় বনফুল হেসে উঠছে। গ্রাম্য মেলার কলরোলের ভিতর আলতা পা কিশোরিরা চুড়ি পরছে।
কথকের চোখ এড়ায় না কিছুই--- হাটের মোরগলড়াই, হাতিঠাকুর, তিস্তাবুড়ি মনসাপালার গান,
লালপার্টি করা হেরম্ব বর্মনের বাপ ,অন্ধকার মাঠঘাট নদিচর কাশঝপ ঘাসে ঢাকা সর্পিল
পথ ঘুম ও ঘামে ভেজা অসহায়তায় আর্ত বিপন্ন প্রান্তিক সময়পর্ব...এক
পালাগানের সুর শরীরে জড়িয়ে যৌথ জীবনের অসামান্য উদ্যাপনপর্ব সুবীরের এই গ্রন্থখানি। সোনালী ধানের গন্ধে জীবনযাপনের লোকগান মকরমুখী
বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে থরে থরে সাজান কষ্টগুলো কান্না মত ঝরে পড়ে, গান হয়ে যায়।
“ধানবাড়ি গানবাড়ি” পাঠ-অভিজ্ঞতা তাই এক মগ্ন যাপনের ভিতর দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা
যেহেতু এই বই অবশ্যপাঠ্য এক কাব্যিক দলিল, এক অনতিক্রম্য শোলোকগাথা, আবহমান দৃশ্যকাব্যের এক মনোরম উপস্থাপন। দূর্দান্ত প্রচ্ছদ
ও ঝকঝকে মূদ্রণে সুখপাঠ্য গ্রন্থটি অধিকতর মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে।
ধানবাড়ি গানবাড়িঃ ৮০ টাকা
সুবীর সরকার
প্রকাশকঃ ধানসিড়ি
প্রচ্ছদঃ সেঁজুতি দাসগুপ্ত
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন