‘The Idea of eternal return is a mysterious one – kundera’
সত্যিই তো কোথায় ফিরবে! এই ঘরগেরস্থালি থেকে এই ঘুরনদোলন থেকে এই সোনালিখাঁচা থেকে একবার পেরিয়ে গেলে কোথায়ই বা ফিরবে! কিন্তু কবি! খুব ভোরে দরজা খুলে সে তো নির্জন এক বাড়ীর দিকে ফিরে গেছে।তার বৃহতা প্রাণের ছন্দ অতিক্রম করেছে নিরেট বাগানদের।আর ঠিক এমনই এক আন্তরিক অপ্রকাশ এমনই এক অশনায়া পিপিসা যা জড়কে চাইছে গ্রাস করতে চৈতন্যকে চাইছে আত্মসাত করতে তারই মাঝে দাঁড়িয়ে অরুন বসুর কবিতারা।ভেতর থেকে ভেতরের দিকে ছুটে আসছে। আর হিম ধোঁয়া ঢাকা চামড়ার শোক নিয়ে আমরাও যেন তাঁর কবিতার কাছে এসে খুঁজে পাচ্ছি এক প্রাপ্তবয়স্ক বিস্মরণের। দেখতে পাচ্ছি ‘ফেরা’ শব্দটাকে কীভাবে একজন কবি তার ছেঁড়াতালি দেওয়া জীর্ণ কাঁথায় নিশ্চিন্তে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন! কীভাবে হ্যারিকেনে অল্প আলোয় দেখতে পারেন মস্ত একটা থাকার অর্ধেক ঘর জুড়েই কেবল একটাই ফেরা। এ প্রশ্নগুলো চিরন্তন আর উত্তরগুলোও তার সাথে আহ্লাদে সহবাসী; কিন্তু যখন কোনো কবি তার প্রজ্ঞানঘনতা থেকে বেরিয়ে এসে খুব সহজ কিছু ঘর গেরস্থ বা টাটকা বেড়ালের মাঝেও খুঁজে নিতে পারেন যাপনের কালশিটে মার্কশিট আর স্কুল পালানো পাখির মত ‘শীতসন্ধ্যার সনেট’ ফেলে ছুটে যান সেই প্রহেলিকা আশ্রমবালকের দিকে, উচ্চৈস্বরে আওড়ে যান যাপনের নিবিড় সহজপাঠ- “গাছে গাছে পাখি ডাকে।/ পাখি ডাকে গাছে গাছে।/কারা যেন ছুটে গেল। ছুটে গেল/ ছুটে গেল রেলগাড়ি।/ঘঘুমারি। হাওয়া গাড়ি”- তখন আমরা , উষ্ণ বালি আর বীজানু ভর্তি এই একটুকরো মানুষরাও কি শীতকে কাঁদিয়ে কুয়াশার নৌকোয় চেপে বসি? অরুন বসুর কবিতা পড়তে পড়তে উঠে আসে এমনই এক অদ্ভুত অবগাহন এমনই এক পিন্ডের দিকে অনন্ত প্রস্থান। কি অনায়াসেই না আমরা দিগন্তজোড়া ফাঁকামাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে মুছে ফেলতে পারি একটি ঘর এবং এঁকে ফেলতে পারি ঘরপোড়া ঘ্রাণ। জলে স্থলে জড়তায় ছায়ায় ঘুমে ঘামে শূণ্যস্থান পূরণ করে রয়েছে তার কবিতা, কখনও গোলাপফুল,কখনও পাখি হয়ে ফুটে আছে আবার কখনও সূর্যাস্তের আনুগত্যে কবিতার কুডাক চেনাতে কবি আমাদের হাত ধরে টানছেন কালচেতনার পৃথিবীতে।
কবির সিগনেচার বা কবিতার ব্র্যান্ডিং নিয়ে কথা হয় অনেক,কথা হয় ব্যক্তিগত একক স্টাইল নিয়েও। যা নাকি কবিকে চেনার অসামান্য উইল, যা নাকি কবিকে স্বতন্ত্র করে অথচ অরুন বসুর এক বা একাধিক কবিতাসংকলনের-এর কাছে এসে বারবার মনে হয় গর্ভের ভেতর অনন্ত জ্বলছেন কবি, জ্বালিয়ে রাখছেন নিজেকে না চিনতে চেয়ে, আবহমানতার কাছে এসে অক্ষরডানা পুড়িয়ে নিচ্ছেন। আর পোড়া ডানায় লেগে থাকছে ছাইলাগা ভ্রমণ। নিজেকেই কি অতিক্রম করছে চাইছেন তিনি! নিজের কাছেই গচ্ছিত রাখছেন নিজেকে পেরোবার অন্ধকার সরু পথ! প্রতিবার নিজেরই শূণ্যস্থান পূরণ করতে নিজেকেই কেটেকুটে কালি লেপে দিচ্ছেন কবি; তাঁর ‘মেঘ ও মৃত্যুর শব্দ’, ‘চতুদর্শপদী’ বা ‘ষড়ৈশ্বর্য’ এর মত সংকলনগুলোতে প্রতিবার খুঁজে পাই নিজেরই উদ্ভিদকে উপড়ে ফেলার উন্মাদনা, কবিতার দেহে মধু মাখানোর নতুন নতুন মৌচাক।প্রতিটি কবিতা সংকলন অরুন বসুকে প্রতিবার নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে, প্রতিবার আমাদের চিনিয়েছে পুরোনো করিডোর ধরে পালিয়ে বেড়ানো নতুন এক কবিকে।
মাঝে মাঝে মনে হয় কবিতা কার কথা খায়! কার ঘরে ঘুমায়!আমাদের প্রাত্যহিক পরমান্নে নুনের বেলা পড়ে আসে আর মায়াপৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে কবি চেনাতে চেষ্টা করেন কুন্ডলিনীর মাঝে রয়ে যাওয়া সেই প্রাগৌতিহাসিক ভ্রূণ।আমাদেরও তো একটা অতিক্রম চাই, আত্মা থেকে ইদমে অনুপ্রবেশ চাই। আর ঠিক এখানেই অরুন বসুর কবিতা ছুঁতে গেলে অস্তিজগৎ থেকে বেরোতে হবে,বেরোতে হবে অনন্ত শ্রমণ হয়ে,কারণ তিনি তাঁর কবিতায় সেই প্রহেলিকা তৈরি করেছেন যাকে কেউ দেখবেনা অথচ যার থেকে দেখা যাবে ‘মায়াবদ্ধতৃষা’ লিপি, অরূপকে দেবে সে দ্বিধা,সুযুপ্তিকে দেবে সে সর্বযোনি। কুন্দেরা তো বলেই দিলেন ফেরা আসলে এক ফেরারী ফাঁকি আর অরুন বসু লিখলেন-“কেবল তুমিই পারো,খাঁচার দরোজা খুলে, আকাশে উড়িয়ে দিতে পাখি”-তবে কি তিনি ফেরার সংজ্ঞা খুঁজে পেলেন? খুঁজে পেলেন স্পন্দনের আদি ঈক্ষণ? ঘুমোবার পূর্বাভাস কিংবা পারাপারের প্রার্থণা তবে কি অরুন বসু চিনতে পারলেন? এ সবই কবির একান্ত ব্যক্তিগত, শরীরের ভার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শব্দের অলখ স্বর।অথচ এসবের সাথেই মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে পাঠক;অরুন বসু যখন বলছেন-“ নৌকা ডুবে যায়,তবু ডোবে নাকো নৌকাডুবি,নদী/স্বর্ণফুল আমাদের ডেকে বলে,‘নির্সগে জড়িয়ো/না’-আমরা ঐ নির্সগের থেকে তাই দূরে সরে গেছি”-
সত্যিই কি দূরে সরে গেছি! নাকি, নৌকাডুবির শব্দে আমরা ফিরে আসছি ‘কাষ্ঠ সরল’ নৌকার কাছেই !
ন হন্যতে
হো-হো করে হেসে উঠলো মধ্যরাত্রে তিনজন বেশ্যা
আমাদের ভ্রূণে যে-জীবন,তারও ছিল দেশসেবা
ছিল লূতাতন্তু সুখ কুর্চিফুল কলমির জঙ্গল
ছিন্নবেশ্ম ছিল ব্রাহ্মী,শোক দুঃখ শান্তির অতল-
ব্রহ্মান্ড এবং শুভজীবনের অমল-ধ্বান্তারি
আমি চলে যেতে চাই কান্তারে,নির্জন এক বাড়ি
অন্তর্জালিযাত্রা তার নক্ষত্র ও দিগন্তরেখায়
তন্মন সমূহ ক্ষণ,খই আর কুহু ও কেকায়
মেঘ ছোঁয় শ্রীমদ্ভাগবতগীতা,চিতার উপরে
কিছুই যায় না দেখা,এমনকী দরজা খুলে ভোরে
মধু ও ব্রহ্মায় নমঃ,কাঞ্চনরঙের বৃষ্টি,কাঁই-
বীচিটির মধ্যে সুপ্ত বিশাল পৃথিবী, ন হন্যতে-
এই লুপ্ত লোপামুদ্রা,জ্ঞান ধর্ম সূদূর বনসাই-
আমি জানি,ছেঁড়া-কানি,জগন্নাথও ফিরে যান রথে
আত্মা
একটি নক্ষত্র তুমি,বৃন্তচ্যুত,খশে পড়লে এই
মধু ও ব্রহ্মান্ডময় পৃথিবীর শিকড় অবধি
তোমাকে ভৈরবী বলা যায় না, এমনকী যুবতীও
না,তবে কি নিশ্চিত তোমাকে আমরা বালিকা জেনেছি
আমাদের ফুল-খেলা,ভুল নিয়ে,কোনো দুঃখ নেই
নৌকা ডুবে যায়,তবু ডোবে নাকো নৌকাডুবি নদী
স্বর্ণ ফুল আমাদের ডেকে বলে, ‘নির্সগে জড়িয়ো
না’-আমরা ঐ নিসর্গের থেকে তাই দূরে সরে গেছি
আর বহুদুর থেকে জরায়ুর মধ্যের গোলাপ
দেখেছি ভ্রূ-মধ্য হতে নেমে-আসা ক্রমশ অস্থির
প্রাগৌতিহাসিক-ভ্রূণে হিঙ্গুলবর্ণের এক সাপ
যে নিজেকে ভেঙ্গে ভেঙে ক্রমশ যুবতী হতে চায়
যেখানে শায়িত শব ভেসে যায় মায়াপৃথিবীর
ব্রীহি ও বালিকা দূরে হেসে ওঠে পরিপূর্ণতায়
শীতসন্ধ্যার সনেট
... বাতাসের সঙ্গে খেলে সন্তানসম্ভবা উঁচু-পেট...
আমি তো চেয়েছি আজ লিখতে শীতসন্ধ্যার সনেট
যা-কিনা নিশ্চিত ছুঁয়ে দিতে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে
এত কাছে থেকে তবু ছোঁয়া হয় না কোনোদিন মাকে
নস্ফটিকবর্ণের মেধা কেন-যে আমাকে নিয়ে খেলে...
কামিনীকাঞ্চনময় অন্ধযুগ বিম্বিত-প্রচ্ছায়
মানুষের দীর্ঘ বেলা দীর্ঘতর হয়ে বহে যায়
প্রজাপতি যদি তার পাখনা দুটি সেভাবে না –মেলে
আমি তো চেয়েছি লিখতে শীতের সুন্দর এক রাত...
আমার দুঃখের দিনে কমলালেবু ,ঝরে শাদাভাত
মানুষের বাড়া ভাতে তবু কে দিয়েছে বলো,ছাই ?
সমুদ্রের মতো নারী- আমি যার মুখ ছুঁতে চাই
বাতাসের সঙ্গে তার সন্তানসম্ভবা উঁচুপেট
মনে পড়ে,লেখা হয় না তবু শীতসন্ধ্যার সনেট
সহজ পাঠ
গাছে গাছে পাখি ডাকে।পাখি ডাকে।পাখি ডাকে।
জলে তিমি গান গায়।গায় গায়।গান গায়।
ডিম পাড়ে শাদা হাঁস।নীল হাঁস ডিম পাড়ে।ডিম পাড়ে।
নদী জল ছলছল।ছলছল নদী জল।
মাছ জলে খেলা করে।খেলা করে।খেলা করে।
নীল ফুল লাল ফুল।ওই খোঁপা ওড়ে চুল।
নদী বয় কুলকুল।কুলকুল।
মৌমাছি।পিপীলিকা।
পিপীলিকা।পিপীলিকা।দলবল ছাড়ি একা।ছাড়ি একা।
কোথা যাও, বলে যাও, ভাই ।
গাছে গাছে পাখি ডাকে।পাখি ডাকে গাছে গাছে।
কার যেন ছুটে গেল।ছুটে গেল।
ছুটে গেল রেলগাড়ি।ঘুঘুমারি।হাওয়া গাড়ি।
এক দুই তিন চার...
নাচে নট,নাচে নটী।নাচে নটী।নাচে নটী।
নাচে ঐ কুমারীর
নাচে বাঘশুমারির
ভয় ভয় করোটি ।
পাঁচ ছয় সাত আট ...
লেনাদেনা বেচাকেনা।ঐ চেনা বসে হাট।বসে হাট।
বসে হাট নয় দশ।নয় দশ ...
কারা যেন তাড়ি খায়।গান গায়।
গান গায়। তাড়ি খায়। খায় রস ।
টোটোপাড়া,সন ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ
নটি আশ্চর্য নদী, কয়েকশো মানুষ-ফুল ছুঁয়ে
ওইখানে প্রকৃতির যা কিছু সৌন্দর্য পড়ে নুয়ে
ভূটানি কমলালেবু,বাঁশফুল,সুপুরিবাগান
যেন জ্ঞানবৃক্ষের মুগ্ধ সন্ন্যাসী ভেঙেছে তার ধ্যান
এই দৃশ্যে শ্বাস নেয় মনুষ্যত্ব,প্রানী ও প্রনাম
এখানে ছবির মতো,খুব ছোটো,টোটোদের গ্রাম
বিদ্রোহ
সন্ন্যাসীকে আমরা মারিনি,তাকে মেরেছে ‘সন্ন্যাস-ই’
উদয়ের পথে তাঁকে আমি আজ ডেকে বলি : উঠো হে প্রকাশি
ডেকে বলি : সন্ন্যাসের থেকে তুমি,সন্ন্যাসীর চেয়েও ঢের বড়ো
যে তোমাকে বেঁধে রাখে কাঁটাতারে,তুমি তার সর্বনাশ করো
প্রেম
‘স্থুল,কিন্তু অপরাজিতার পাশে বেমানান নয়’-
অধ্যাপক মৃদু হাস্যে চশমাটিকে রুমালে মুছলেন
সূর্যাস্তের শেষ আলো তখন ছুঁয়েছে ওই কদম্বপুষ্পটি
‘আপনি কী বলেন?’
অর্ধনিমীলিত চোখ,রমনী হাসলেন :
‘উরুৎ উদভ্রান্ত হলে মোহিনীও ভেঙে পড়ে শোকে’-
তখন গোধূলি , চাঁদ নেমে আসে রমনীর শরীরে, অলকে
আগুন, মনীষা
যতদূরে যেতে পারে,সব মানুষের মনুষ্যত্ব
আমি তার থেকে আরো দূরে চলে যাবো
অশনিসংঘের প্রতি যেরকম চলে যায় নারী ও নৃতত্ব
সেরকমই নক্ষত্র ও নদীর সবুজ আমি শরীরে জড়াবো
আর ওই সবুজের সংগে আমি নদীর ওপারে এক মায়াবদ্ধতৃষা
আমাকে দেখবে না কেউ,আমি সবকিছু দেখবো-
আগুন, মনীষা ।
রমণ
প্রথমে একটিমাত্র বিড়াল একবার ডাকবে :
মিঞ
এইভাবে একবার দুবার ক্রমে
পাঁচবার
সাতবার
তারপর বারবার বারবার
সারাঘর ভরে যাবে শাদাকালোহলুদবেগুনি সব
লোমশ বিড়ালে …
ভয়ে, ভালোবাসায় শিউরে উঠবে বিড়াল-উৎসব
কিন্ডারগার্টেনে তার ছোট্ট সাতবছরের মেয়ে যাবে
ভোরের ইস্কুলে
কে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে চোখের আলোয়
সুখের ভিতর হতে দম্পতিও এই ভয়ে কুপি
জ্বেলে দিতে গিয়ে দ্যাখে,কী আশ্চর্য,
তাদের শরীর,সঙ্ঘ সমস্বরে বিড়ালের মতো
মধ্যরাতে ডেকে ওঠে :
মিঞ
কবি
একটি নিমগ্ন-পাখি,তার আঁখিপল্লবের ভিতরে মহিষ
দেখেছি সোনার পাত্রে স্নেহাশিস, খেলা করে তীব্র মৃত্যুবিষ –
তোমার সম্মুখে তাই,চেয়ে দেখো,বৈদ্যুতিক-চেয়ার ও জেলখানা,
বন্দীর বন্দনা-গান,অস্ত্রের ঝনঝনা
কাদা ও নোংরা মাখামাখি-
কেবল তুমিই পারো, খাঁচার দরোজা খুলে, আকাশে উড়িয়ে দিতে পাখি
হে সর্প : ন্যায় ও রমনীর প্রতি
এইসব লেখা হলো ততধিক তুলোটকাগযে
তুমি শ্যামল সবুজ ছুঁয়ে ছেলেবেলার নদী ও বুড়িবাসন্তীর মাঠে
খল ও নির্ভুল জ্যোৎস্নায়
অনির্বচনীয় হয়ে উঠলে
আমি অণোরোনীয়ান যোনিমন্ডলের দিকে
ক্রমশ ব্যাথাতুর বাঁশি ও নির্মাণ
কেবল ভ্রাম্যমাণ বৃক্ষের তলায় অনাবশ্যক আশ্রমবালক
সূর্যের সুতো দিয়ে সেলাই করছে জামা ও পট্টবাস
গুরুর সুখের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে নিজের দুঃখ
আর প্রগাঢ়-তামস
অথচ তারিনীপুরুষের পায়ে মৃতশুয়োর ও রাত্রিস্ত্রোম কলহাস্য
ন্যায় ও রমনীর প্রতি :
হে সর্প তুমি এই পুরীর পালনকর্তা ও ইষ্ট
আমাকে গীতিরসবাক্যে উজ্জ্বলিত করো
আমাকে মুক্তি ও বিলোকে ধর্মান্তরিত করো
আমাকে খেদ ও সুষমায় সঞ্চারণ করো
সঞ্চারণ করো সঞ্চারণ করো
আমাকে সঞ্চারণ করো
এবং, আরো লিখি:
সরল পত্রবাহকের হাতে,ক্ষমা ও ঈশ্বরের লাশ
একই সঙ্গে মদীয় ভবন ছেড়ে দিন
অ্যাশট্রে ও পাঁচমুড়ার শিল্পীরা
অ্যাশট্রের ভিতর থেকে উঁকি মারছে ক্লান্ত যোদ্ধা,
বড়ো দুঃখী শিল্পী-পরিবার
উঁকি মারছে অনাহার,টেরাকোটা,বাসি-পোড়ারুটি, আর
সন্তানের স্তব্ধ মুখচ্ছবি-
আমি এই সবকিছুকেই দগ্ধদ্বন্ধে অবশিষ্ট
ছাইয়ের ভিতরে এনে আজ
শিল্পের বেহেশতে-আঁকা প্রায় এক হাজার কোটি বছরের
বুড়ি পৃথিবীর
অশ্রুর ভিতরে দেখি, শতপুষ্প হয়ে দূরে,
ফুটে উঠছে ধীরে-ধীরে
আনন্দভৈরবী
শ্রীনিবাস:একটি বিভ্রম
শ্রীনিবাস কোথাও ছিল না;কিন্তু, রোজ রাতে আমি ‘শ্রীনিবাস, শ্রীনিবাস’
বলে কাউকে ডেকেছি।কেউ সাড়া দ্যায়নি জেনেও ওই মন্বত্তর পার হয়ে,
গোপনে ইঁদুর-কলে কয়েকটি ইঁদুর আর তাহাদের কাটা-লেজ পৌঁছে দিই
স্বপ্নে মায়ানমার।আর,এখানেই,অবশ্যম্ভাবি,শরৎবাবুর কথা,বড়ো বেশি
মনে পড়ে বার্মাগামী জাহাজের দুলুনিতে ভীত কিছু মানুষের-মানুষীর
মুখ।এরও পর-অনেক পরের কথা-এসে যায় প্লেগ,মৃত্যু আর মহামারীর
বাতাস-মূল্যবোধ শোধ করে মনুষ্যত্ব ঋণ। আর এই উপাখ্যান থেকে কিছু
-দু কদম-পিছু ফিরে দেখি। শ্রীনিবাস হয়তো কোথাও ছিল।শ্রীনিবাস,
বস্তুত,কোথাও ছিল না।
পাখি
‘পুলক শুরুর মুখে উড়ে এসে পড়েছিল মিলনমূর্হুতে একটি
পাখির পালক’-
এই পঙক্তি সপ্তর্ষির, এই পঙক্তি শুধুমাত্র সপ্তর্ষির নয়-
মহাজাগতিক এই রক্তলাজ-পঙক্তিটির নিচে
রয়েছে টানটান শুয়ে,যেন ম্লেচ্ছ,তাতার বালক
আমি শুধু পুলকিত,পাখি বিষয়ক গ্রন্থে,পাতায়-পাতায়
নিজেকেই অবশেষে,মিলনমূর্হুতে এসে,আবিষ্কার করি:
সূর্যাস্তের শেষ-আলো,যেন ছিন্নমস্তার শরীরময় নীলোৎপল-বিছে
যেন আমি, একটি গোলাপফুল,পাখি হয়ে ফুটে আছি
বহুদূর স্থানাঙ্কের নিচে
আমার খুব প্রিয় কবি । নির্বাচন সুন্দর যদিও উল্লেখযোগ্য আরও অনেক কবিতা আছে যেগুলি উনি খনন-এ লিখেছিলেন । অরুণদা সম্ভবতঃ একসময় আমার অধুনালুপ্ত "মাংস ও মনীষা' ছেপে দিয়েছিলেন পরম মমতায়, ঠিক মনে নেই । আগামীতে রমেন্দ্রকুমার, মণীন্দ্র এবং যোগব্রতর কবিতার প্রত্যাশা রইলো ।
উত্তরমুছুন~ সুকুমার