সুনীল কুমার
নন্দী
(১৯৩০......)
(কাব্যগ্রন্থ-‘ভিন্নবৃক্ষ ভিন্ন ফুল’, ‘প্রকীর্ণ সবুজে
নীলে’ , ‘সেই মুখ’, ‘ পিচ্ছিল গুহার জল’, ‘ অনন্ত উদ্ভিদে
রক্তে’,
‘ মাটি জল স্মৃতি’ ,’মেঘ, পাখির ডানায়’’)
১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং দশম
কাব্যগ্রন্থ ২০০১ সালে- দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে একজন কবি যখন সৃষ্টির অক্ষরে খুঁজে
চলেন আবিষ্কারের আনন্দ তখন কবিতা তাঁর কাছে আর প্রতীক না থেকে হয়ে ওঠে পার্সোনা। সুনীলকুমার
নন্দীর প্রসঙ্গ উঠলেই কবিতা কর্মের ধারাবাহিকতার এমনই অনন্য নজির উঠে আসে; তবে
সেভাবে পাঠক যোগসূত্র ঘটেনি কবির কপালে; হয়ত আত্মমগ্ন কবিদের ক্ষেত্রে সেটাই
স্বাভাবিক, নিমজ্জিত নিমগ্ন থেকে তারা নিজেরাই হয়ত এমন এক দূরত্ব তৈরী করেন যেখানে
কোনো প্রচুর পাঠকের উদ্ভাস নয় বরং স্থির প্রক্ষিপ্ত এক পৌঁছোনোর ধারনা আছে। আলোচক
সুমিতা চক্রবর্তী কবি সুনীলকুমার নন্দীর এই আত্মমগ্নতা এবং প্রথাগত বাহ্যিক
পাঠকপরিসরের বাইরে তার থেকে যাওয়ার স্বপক্ষে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন-‘এই আত্মমগ্নতায় যদি না সন্ধান করে নিতে পারি অন্তরতলের গভীর
কোনো উপলব্ধি-বিন্দু তা হলে তাঁর কবিতার প্রবাহ ও বিবর্তনকে বোঝা যাবে না। সেই
উৎসারন সম্পূর্ন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গির মৃদু কথন। যদিও তিনি কবিতার করণ-কুশলতা
সম্পর্কে সচেতন তবু সেই রূপকলা সাধারন পাঠককে কতটা টানবে, এই ভাবনা তাঁকে কখনও
স্পর্শই করে না। তাঁর কবিতার নির্মাণ-চেতনা জাগ্রত থাকে কেবল এই দায়িত্ববোধ সামনে
রেখে, উপলব্ধির ভাষাশিল্প-রূপ যেন যথাযথ হয়। যেন সেখানে কোনো ফাঁক না থাকে। এই
কবিরা কিন্তু কখনও সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যান না। মাঝে মাঝে তাঁরা পুনরাবিষ্কৃত হন।
এই কবিরা অধিকাংশ সময়েই কবিতা সৃষ্টির ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে যান না।“- হ্যাঁ, কবি সুনীলকুমার নন্দী সেই কবি যিনি কখনই পাঠককে
কবিতার আকর ভাবেননি বরং ভীড়ের মধ্যেও, প্রতিষ্ঠানের পিটুলিগোলা প্রতিবেদনের মধ্যেও
জাগিয়ে রেখেছেন সমান্তরাল এক প্রতিজগত, যার পূর্ণতা স্বয়ং কবি চাননি কিংবা যার
পূর্ণতার জায়গায় কেবল বাইরের থেকে ভেতরের দিকে টান দেওয়া।
১৯৫৫ সালে পুর্বাশা পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর অনুক্ত
নামের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সুনীলকুমার আর ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দশম
কাব্যপুস্তিকা ‘মেঘ,পাখির ডানায়’ , তার পরেও তিনি নিয়মিত লিখেছেন,ফলে তাঁর লেখনির শিল্পরূপে
ভাববস্তুতে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে সেটাই স্বাভাবিক; যিনি তাঁর প্রথম দিকের কবিতায়
প্রেম কল্পনার শীতলপাটিতে আশ্রয় নিতেন নব্বইয়ের শেষে তাঁরই কবিতায় উঠে এসেছে
সামাজিক অনুকল্প , উঠে এসেছে প্রবাহমান ক্ষয়ের স্নায়ুশিরাগুলি। সুনীল কুমার নন্দীর
কবিতা মূলত লিরিকধর্মী তবে সে লিরিক কখনই কবিতার শরীরজুড়ে বসেনি বরং তার নিকটতম
প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে বোধের বাহারপাতাগুলি। পঞ্চাশের কবি সুনীলকুমার , কিন্তু কালানুক্রমিক
পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাঁর সামগ্রিক কবিতাযাপনে। তাঁর লিরিকধর্মী কবিতারা
প্রবহমান ছন্দের রূপকল্পে বিশ্বাসী হয়েও প্রাঞ্জল। ‘মেঠো হাওয়া’ কবিতায় তিনি যখন
বলছেন-
“ আরে কি অবাক, বকুলের ঘ্রাণ-জড়ানো মাঠের ঝুরু ঝুরু হাওয়া,
তুমি
এলে নাকি
শহরের এত সরু অলিগলি পথ চিনে চিনে !
ঘুম
কেড়ে নেওয়া ভীরু স্মৃতিপাখি ...”
শহরের সাথে স্মৃতিকে মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়ে সুনীল
যেন স্তর থেকে পেরিয়ে এলেন স্তরান্তরের রসায়নে, যা কবিতাকে ছন্দমিলের বিশ্লেষন
থেকেও দিল কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক বিস্ময়। আবার কেবল প্রেম বা যৌবনের আনন্দ বেদনাই
হয়ে ওঠেনি তাঁর কবিতার একমাত্র প্রত্যয় বরং ষাটের দশকে লেখা কবির কবিতাগুলিতে আমরা
পাই অস্থির রাজনীতির ঘোলাটে পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে এক কবির অভিমানী ছায়াপথটিকে। হয়ত
তাঁর কবিতাকে রাজনৈতিক বা সামাজিক কবিতা বলা যাবেনা কিন্তু কবিতার বিশেষ বিশেষ
চরিত্রগুলিও এসময় দীপ্যমান হয়ে উঠেছে মূলত তৎকালীন আর্থরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের
আলোকেই। এ প্রসংগেও আলোচক সুমিতা চক্রবর্তীর কিছু উদ্ধৃতি সরাসরি গ্রহণ করতে পারি
আমরা-“ সুনীলকুমার নন্দী ষাটের দশকে নিজের সমাজ
সংবেদী হৃদয়ের লক্ষ্যবিন্দু যেখানে স্থাপন করেছিলেন তা রাজনীতি নয়, তাঁর চোখের
সামনে উদঘাটিত হয়েছিল দেশের দরিদ্র মানুষের, কৃষক ও শ্রমিকের প্রকৃত অবস্থা। সেই
ষাটের দশক খাদ্য সমস্যায় দীর্ণ হচ্ছিল। খাদ্যের দাবিতে মিছিল করলে কৃষকের উপর
চালানো হয়েছিল গুলি। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সুনীলকুমার নন্দীর কবিতায় বারবার দেখা
যায় এক গ্রামীন কৃষকের মূর্তি তখন বোঝা যায় কতখানি তাঁকে আঘাত করেছিল সেই
ভাঙন-ক্লীষ্ট, অনাহার-পীড়িত,বিভ্রান্ত সময়। এই কৃষকের নাম তিনি দিয়েছেন করিমচাচা।
স্বগ্রামেই পরবাসী সে, খাঁ খাঁ বুক থেকে উঠে আসে শুকনো কাশি। তার চারিদিকে খরায়
পোড়া গ্রাম। তার সমগ্র অবয়বে কঠিন সময়ের অভ্রান্ত করুণ মুদ্রা। একাধিক ফিরে ফিরে
এসেছে করিমচাচার চরিত্রটি।“...
আসলে সচেতনভাবেই কবি যেন উত্তোরত্তর চান
নিজেকেই উত্তীর্ণ হতে, এবং একজন কবির
অনুভূতিদেশে এই ভ্রমণ হয়ত সবসময় উদ্দেশ্যহীন নয়,কারন কবিতা তার কাছে কেবল কথা বলার
পরিসর নয় বরং শব্দের মধ্যে নিচু করে মাথা গলিয়ে দিয়ে তিনি আসলে কখনও বা স্মৃতির
কখনও বা ক্রমবর্ধিত শূন্যের অংশীদার হতে চান আর চেতনার বিস্ফারনে এই চারপাশের
কোলাহলের থেকে নিকটতম নীরবতায় পৌঁছনোই হয়ে ওঠে তার সাহিত্যজীবনের একান্ত সাধনা ।
কবিতার মধ্যে দিয়ে কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সুনীলকুমার নন্দীও যেন বারবার পৌঁছোতে
চেয়েছেন এইধরনেরই এক নিরাসক্ত স্থিতি অবধি। সেখানে শব্দের খেলা ছেড়ে বাকের ম্যাজিক
ছেড়ে কয়েক দশক ধরে বোধের এক অলৌকিক ভ্রমণ...
বিষ
জলের কোথায় দোষ, কোথায় জলের স্বেচ্ছাচার
স্বাভাবিক নিয়মে নেমেছে জল
ঢালে-ঢালে, প্রসারিত হতে চায় সমুদ্র-বিস্তারে-
কথা ছিল
সুগঠিত বাঁধে-বাঁঢে শিবের জটায়
বেঁধে জল, জলস্রোত নিয়ে যাব
নদীর গভীর বেয়ে, খালে খালে বহতা ধারায়
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, মাটির তৃষ্ণায়
মাঠে
-খরার ফাটলে
কথা কে রেখেছে?
কেউ তো রাখেনি ভুল,ঘুমঘোর
আমাদের যা কিছু নির্মাণে,কথা
না রেখে, এখন বলছি
জলে দোষ
জলের প্রবল চাপে
ব্যারেজের নাট বল্টু খুলে যাচ্ছে, আহত বাসুকি
ছোটে, ছুটে চলে
আবর্তে ফেনিল, জল
ইতিমধ্যে বিষ
কোথায় রয়েছে দোষ, কার অবহেলা গূঢ়,কার
স্বেচ্ছাচার !
ঘামে ভেজা মাটি
থই থই জ্যোৎস্নায় উড়ছে,
উড়ে যাচ্ছে মধ্যরাত,
ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোড়া
সমস্ত শূন্যতা, নাকি টেনে
এনে পলি
ঢেকে দিতে চেয়েছিলে।
ক্ষয়লাগা বনেদি গম্বুজ
ভেঙে আসা ভরা জল,ঝাঁকে
ঝাঁকে ঘোড়া
নিয়ে তুমি এলে, যেন
কেমন পাথুরে মূর্তি
আকাশ-পৃথিবীজোড়া ধানরঙা
এমন জ্যোৎস্নায় ।
ডানামেলা অন্ধ যুগ,
অন্তহীন অবোধ মিছিলে
প্রতিহত হতে হতে, ক্রমাগত
হড়কানো ঘোড়াকে
সামলাতে না পেরে আজ পড়ে আছ
ঘামে ভেজা সারা মুখ,
মিছিলে হলুদ হওয়া ঘাসে। মধ্যরাত
থই থই জ্যোৎস্নায় উড়ছে,
ঝাঁকে ঝাঁকে ঘোড়া
উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যায় কোথায়
কে জানে ।
জীবন ছড়ানো,দেখো
কোনো পরাভব নয় শেষ কথা ।
তুমি
মাটি থেকে তুলে বুক
কঠিন স্তব্ধতা ফেলে এসো,
উঠে এসো,
জল নয়, পলি নয়, আহত বুকের
ঘামে ভেজা ভেজা মাটি
সমস্ত শূন্যতা ভুলতে
তোমাকে আমাকে হয়তো এই যে
এনেছে পাশাপাশি ।
যে আলো-না,
জ্বলেছিল
হারিয়ে যায়নি,
ফিরে আসে
এদেশের বুকচাপা
অন্ধকারে কোনো একদিন
যে
আলো-না,জ্বলেছিল
অনেক চোখের হয়ে
অনেক দূরের কিছু চোখে ।
সুফলা মাটির বুক
খাক করে ব্যাভিচারী যত অন্ধকার
সরাতে, যাদের চোখে
জ্বলে ওঠে আলোর মশাল-
এ বড় অসম যুদ্ধ,
হয়তো বা তাই
প্রতিহত হতে হতে
তারা নাকি
বুকচাপা অন্ধকারে
অন্ধকার হয়ে মিশে আছে ।
তবে ওই শুদ্ধ
অগ্নি, আলোর মশাল
একবার জ্বলে যদি,
জেনেছি নেভে না-
ফিরে ফিরে আসে যেন
অনন্ত শিখায়
অনেক চোখের হয়ে
অনেক দূরের কিছু চোখে ।
মাটি জল স্মৃতি
কিছুই যায় না খোয়া –
খসে পড়া রাজ্যপাট,অচল
আধুলি
সবই নাকি
মাটি জল ধরে রাখে, ধরে
রাখে স্মৃতি
নীল অনুভূতিমালা
ব্যাথা দেওয়া, ব্যাথা
পাওয়া, কে কথা রাখেনি
কথা
রাখতে গিয়ে
একা ঘরে কার পাখি হয়েছে
শিকার ।
কী জানি কে রাখে কী, তা
এখনও বুঝিনি, তবে জল
কখন যে মরে-গেছে বালির
চড়ায়,মাটি
ক্ষয়ে যাচ্ছে, অবিরত ক্ষয়ে
যাচ্ছে পায়ের তলায়-
আর একটু গভীর হয়ে এসো,
দেখবে
শরীরের ভিতর অবধি
প্রতিটি ধমনীময়
কখনো বন্যার চাপ, নেমে আসে
কখনো-বা খরা ।
সামলাতে পাথর টেনে, কুঁয়ো
খুঁড়ে
দিন যায়, দিন আসে
ছন্নছাড়া, থিতু হতে কোথায়
তেমন বাসভূমি-
জানা হয় না
কাকে বলে
সুখ দুঃখ অনুভব ধরে-রাখা
স্মৃতি ।
ফেরা
বকুলতলায় উড়ছে বসন, উন্মনা
মুখ কার প্রতীয়ক্ষায়?
জানি,তবু হয় না ফেরা।
প্রতিদ্বন্ধী, এই যে সময়
চতুর্দিকে সাজিয়েছে তার
যোদ্ধাশিবির,
ফিরতে গেলে তুলতে থাকে
মাঠফাটা এক অট্টহাসি-
অহংকারী বুকের রক্ত চলকে
ওঠে
ঘোড়ায় লাগাম টানা দিয়ে ফের
রণক্ষেত্রে ছুটে আসি।
জয়পরাজয় অন্ধকারের ডানায়
মোড়া
হয়তো হবে, ছুটছে ঘোড়া
লক্ষ থেকে
লক্ষবিহীন-
যেহেতু, আজ প্রতিদ্বন্ধী,
এই যে-সময়
ভুবনজোড়া ধ্বংস নিয়ে বাজি
খেলছে, ভোরবেলাকার
সন্ধিপত্র
মধ্যরাতের বিস্ফোরণে যায়
পুড়ে যায়, জতুগৃহ।
কপটচারী চক্রব্যূহে, হঠাৎ
কখন
ভরাচাঁদের আলোয় যেন
ভেসে আসে
বুকের গভীর গন্ধমাখা
উন্মনা মুখ,বকুলতলা ।
হা-হা ভূমি, ছুটছে ঘোড়া,
ঝড়ের বেগে
ছিন্নভিন্ন বনের লতাপাতার
মতো উন্মনা মুখ, বকুলতলা
জেনেও, আমার হয় না ফেরা-
ফিরতে গেলে কানে বাজে,
মাঠফাটা সেই অট্টহাসি ।
পা চালিয়ে এসো
এই তো সাঁকোটা সবে পার
হয়েছি, না দাঁড়িয়ে
পা চালিয়ে এসো ।
এখনো বিস্তর পথ। পৌঁছতে
মেলায়
সামনে পড়ছে
মাইল মাইল দীর্ঘ অরণ্য,
বিশাল অন্ধকার
ছড়িয়ে রয়েছে, যেন
শ্রাবণমেঘের পুঞ্জ
লতাগুল্মে গাছে গাছে
শাখা-প্রশাখায়-
পথ
অন্ধকার কাঁটাঝোপে মেলানো
কঠিন, মিশে আছে
ক্ষিপ্র চিতা, কালকেউটে
আদিম গুহার মতো ঝুঁকে-আসা
কাঁটাঝোপে,লতায় পাতায়।
আর একটু তৎপর হও। মেলায়
পৌঁছবে বলে
পার হতে এ-ভয়ংকর হিংস্র
বনভূমি
অনেকে হারিয়ে গেছে, ফেরেনি
যে ঘরে
নিশ্চয়ই ভোলোনি? তা কি
ভোলা যায় ! পা চালিয়ে এসো ।
আস্তে, তোরা আস্তে
চোখ বুঁজেছে এই তো সবে।
আস্তে, তোরা আস্তে ।
তর্ক গোছা। ব্যয় করেছে
যতটা, তার সাধ্যে
ছিল কিনা কষতে হিসেব রাত
পোহাবি মিথ্যে ।
এক স্রোতে কী সব নদী বয়?
বীজ ছড়ানো শস্য
ফললে ঘরে সব তোলেনি, আড়াল
দিয়ে অন্যে
এদিক ওদিক অন্ধকারে সরায়,
তার আলস্য
ওড়ায় সোনা, বলবি তোরা ;
শেষ পরিণাম এই যে
দেউলে হয়ে চোখ বুঁজল,
বসতবাড়ি নড়ছে ।
নড়বড়ে ওই যা-বা দেখিস,
তোদের ভাঙ্গা আয়নায়
তাও ফেলে যে যায়, চলে যায়,
বোঝাবুঝির ঊর্ধ্বে
শূন্যে একা তুলল পাড়ি, কেউ
নিল কি সঙ্গ!
চোখ বুঁজেছে এই তো সবে ।
আস্তে, তোরা আস্তে ।
দোনা-পাওলা
পাহাড়-সমুদ্র-মাটি-বনরাজিনীলে
ছড়ানো এত যে রূপ, এত রূপে
স্ববিরোধী উদাসীন শরীর,
শরীরে
চোখ
খুঁজে ফেরে
ভাসাভাসা রহস্যেরযত-না
সংকেত,দেখো
আর একটু গভীর হয়ে
মাটি-জলে মাখামাখি বুকের
ভিতরে, বুক
আবরণ খুলে খুলে অমলিন
রক্তের আবেগ
হয়তো জাগাতে গিয়ে অদ্ভুত
নিয়মে যেন প্রতিহত-
প্রতিহত হতে হতে পরাভূত
পৃথিবীর বুকচাপা দাহ
পাহাড়ের ঢাল থেকে ঝাঁপ দেয়
সমুদ্রে, যেহেতু
সমুদ্র নেয় না কিছু
ফিরে এসে ভরা ঢেউয়ে মাথা
কোটে কঠিন পাথরে ।
রূপবতী গোয়া যেন ভেজা
বালুতটে
নুয়ে আসে, নুয়ে এসে
মাটির শিকড় বেয়ে
ঝাউয়ে ঝাউয়ে,
বনে-বনান্তরে, তার সমস্ত শরীরে
তুলে আনে
সমুদ্রে ধূমল সেই আহুতির
বাষ্পপুঞ্জ, দীর্ঘশ্বাস-
হাহাময় দোনা-পাওলা,স্মৃতির
বিষাদ ।
সেই বই
সেই বই
কবেকার কেমন রাঙানো
সন্ধ্যা
আমার কিশোর ছেলে ধূলো ঝেড়ে
তুলে আনতে
হেমন্তের হিম হাওয়া জড়ানো
কুন্তল
সরিয়ে যে-মুখ ভাসে রক্তের
প্রবাহে যেন
পদ্ম না না, পদ্মের মৃণাল-খসা
ভাসমান বিবর্ণতা ...
এখন চেনাই দায়
এই সেই পদ্মরাত আনত উষসীঘন
আমার ভুবন, সেই
জ্যা-মুক্ত রক্তের শিখা
সেও যেন ইতিমধ্যে ভৌতিক
শীতল,
অথচ তেমনই চলছে প্রাত্যহিক
লেনদেন, সংলগ্ন সংসার-
কিছুই টলে না বাইরে, তা না
–হলে এত অনায়াসে
লোকগুলো বাসে ঝুলছে,
ফেরিওলা হেঁকে যায় গলির কোণায়,
কপালের ঘাম মুছ
শিস দিয়ে পথে নামি,
সিগারেট কী করে ধরাই !
লোকটি
ওই যে লোকটি দেখলে,
সংসারের আরক্তিম রাখি
ছিঁড়ে ফেলে
আত্মীয়-বান্ধবশূন্য এ নির্জন প্রান্তরে একাকী
করেছে ফুলের চাষ। আপাতত
তাকে যদি মনে হয় অদ্ভুত খেয়ালি
বিস্মিত হব না। কিন্তু আর
একটু গভীর চোখে দেখো দেখবে, এই রুক্ষ বালি
সরিয়ে সরস মাটি ঢেলে ঢেলে
প্রানান্ত নিষ্ঠায়
মনের বাসন্তী ইচ্ছা গাছের
সবুজ বৃন্তে, ফুলে ফুলে তুলে ধরতে চায়।
নিপুণ যত্নের স্পর্শ
সর্বত্র ছড়ানো দেখো, বাগানের প্রতি গাছে ফুলে-
রঙ্গন টগর যুঁই রজনীগন্ধার
সঙ্গে এক ঝাঁক কদম্ব বকুলে
দৃষ্টির বিমুগ্ধ তৃপ্তি ।
হায়রে মানুষী ইচ্ছা নিবিড় সবুজে আর
ফুলের মায়ায়
তথাপি কি পূর্ণ হয় ? এত যে
তন্ময় স্বপ্ন, ব্যর্থ হয়
ফুলের আঘ্রাণে মত্ত রাত্রির হাওয়ায়
দীর্ণ হয় অন্ধকারে
রক্তাক্ত ব্যথায়,
ফুটন্ত বকুলবনে বিপন্ন
যৌবনজ্বালা তীব্র যন্ত্রনায়
খুঁজে মরে তোমাদেরই মতো এক
রূপসীর স্বর-
আরে কী আশ্চর্য দেখো,
যার স্মৃতিসঙ্গ মুছতে অবুঝ
লোকটি তার ছেড়ে এলো ঘর !
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন