• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

সম্বিত বোস

রাত ফুরোলেই ভোর


‘One inch of love is one inch of shadow
Love is the shadow that ripens the wine’

অচেনা ঘরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়; অন্ধকার আর গুমোট মিশে ঘরটাকে গুমোট করে তুলেছে। মাথার ভারে বালিশের কোণঠাসা তুলোরা তাদের ঝোড়ো উড্ডীন অতীত ভুলে প্রস্থরীভূত হওয়ার প্রয়াসে মনোনিবেশ করছে। এহেন প্রচেষ্টা কে কি তুমি বিকৃত বলবে? উনবিংশ শতাব্দির অজ পাড়াগাঁয়ের বালি বিধবা যদি সম-অদৃষ্টা বুড়ি বিধবা পিসির সাথে তাল মিলিয়ে বলে, ‘ম্যাগো! মাছ আবার কেউ মুখে দেয় নাকি? ভর্তি কাঁটা আর বিশ্রী আঁষটে গন্ধ। ঘেন্না! ঘেন্না! ...বেঁচে থাকুক আমাদের বেলের মোরোব্বা আর আম-পোড়া সর্বত।”? অথবা এসোপের সেই কালজয়ী ফেবেল যার সারাংশ ‘আঙ্গুর ফল টক’? যে মাথার ভারে তুলারাশীরা বিধর্মী, চরিত্রভ্রষ্ট, সে মাথা কিন্তু এ মুহুর্তে শরতের দলছুট মেঘ সাবকের চেয়েও হাল্কা, ঈগলের অতর্কিত আক্রমণে পাঁজরের খাঁজে নখের তীব্র আদরে আর রক্তের আর্দ্রতায় মৃত্যুদর্শী বিচক্ষণ চড়াইয়ের চেয়েও ভীত, হতবাক। মশা তাড়ানোর ধুপটা জ্বলে শেষ হয়ে গেছে – খন্ডিত চক্রাকার পথে চৌকো ক্রস-সেক্সান বিশিষ্ট ছাই দিয়ে ধূপের অসংখ্য সম্ভাব্য অতীতের একটিকে নথিবদ্ধ করার মহাকালের আপাতপ্রয়াস। অবচেতন – সচেতনের অদৃশ্য ভেদরেখা মধ্যযুগীয় ইয়োরোপীয় রাজত্বের ভৌগলিক সীমারেখার মতোই সদাপরিবর্তনশীল! গরম লাগছে...পাখাটা বন্ধ। মাথার ওপর মশা ভন্‌ভন্‌ করছে। ডিম্‌লাইট ক্লান্ত হতে হতে, অভিমানী বাল্বে্র ক্লান্তি অস্বীকার করে মুখ হাঁ করা তপ্ত বিলাপ – এমন মায়াবী আলো অথচ দেখার কেউ নেই! ঝিমে আলো এলোপাথাড়ি ঘরময় ছড়িয়ে, বিছানা চাদরের ফাঁক ফোকরে উঁকি মেরেও শরীর অথবা মন ছুঁতে না পেরে অবশেষে নালাপথ বেয়ে গড়িয়ে যায়...তারপর পাইপ বেয়ে নেমে পলাতক আরশোলার পাখায় ক্ষনিকের জন্য নিলাভ আভার সঞ্চার করে ঝাঁঝরি দিয়ে এক ফাঁকে বেরিয়ে মহানন্দে জ্যোৎস্নায় গিয়ে মেশে।

জোরদার ঘুম নেমেছে শহর জুড়ে। বিষয়ী বিষাদগ্রস্ত মস্তিষ্কেরা ঢলে পড়েছে দৈনিক মৃত্যুর মোলায়েম মৌতাতে। উদরের ওঠা-নামা আর নাসিকা-ধ্বনিতে কিঞ্চিত বিব্রত আরশোলা ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গের দল। রাস্তায় ল্যাম্প-পোষ্টের সারি একে অপরের ছায়া চুরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে, খানিক ঝিম মেরে তারপর আলেয়া বেশে আপাত-আলিঙ্গনরত। বৃদ্ধ চৌকিদার সারারাত টহল দিয়ে তার চেয়ারে বসে খৈনি বানাচ্ছে, দেশ সেই ছাপড়া জিলায় – রাতে টহল দিতে দিতে বৌমাদের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে...পেট গুড়গুড় করে...আর এই দুর্বল মুহুর্তগুলকে সায়েস্তা করতে সে জোরসে ফুঁ লাগায় তার হুইসেলে – পরপর তিন বার, ল্যাম্প-পোষ্টে লাঠি ঠুকে খবরদার হেঁকে তবেই খান্ত হয়। নির্জন রাস্তায় নির্বাসিত বৃদ্ধ প্রহরীর একমাত্র সঙ্গী রাস্তার কুকুর আর ঘরভোলা লম্পট মাতালেরা। সেই জন্যই তো রামদুলাল তার দুঃসহ দেশোয়ালী খিদেকে শাসন কোরে, একটা বা দুটো চাপাটি রেখে দেয় পকেটের প্লাস্টিকে। সারারাত ওই রুটির লোভ দেখিয়ে, কখনও বা একটু দিয়ে চত্তরের সমস্ত কুকুরদের সঙ্গে নিয়ে ঘোরে... জীবের জন্মগত দলবদ্ধ হওয়ার প্রবৃত্তিকে কি অস্বীকার করা যায়, বিশেষ করে নিঝুম গা শিরশির করা একলা রাতে? এহেন লগ্নে জেগে থাকে হাস্পাতাল, স্টেশন, পুলিশ চৌকির লক আপ আর শ্মশান; জঠর যন্ত্রণায় জেগে থাকে বেশ কিছু নিয়ন পীড়িত ফুটপাথবাসী, বেয়াড়া পীড়িত পাতাখোর আর হস্তমৈথুন জনিত অনুশোচনায় ধার্মিক নাবালক। ইচ্ছে করে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুনিয়ে দিই কলেজসৃষ্ট, মির্জা গালীবের বকলমে বানানো সেই বিখ্যাত পানু সায়েরীঃ

‘যবতক ইন মুঠঠী মে হ্যায় দম্‌
ইস হাত সে কাম চালায়েঙ্গে হম্‌!’
তবে বেশ্যালয়ের নিদ্রাহীনতা এক্কেবারে আলাদা। ক্রমে ফিকে হয়ে আসে দালাল আর মস্তিবাজদের ঝিল, সদ্য যৌবনে পাওয়া অজ্ঞাতকুলশীলদের মাতলামি আর হিংস্র বেয়াড়া বাওয়াল মিশে যায় নবাগতা বনিতার শেষ রাতের তীক্ষ্ণ শীৎকারে – শুরুতেই হাতে লিঙ্গ-মর্দন করে বীর্যপতনকে ত্বরান্বিত করার কৌশল এখনও শেখা হয়ে ওঠেনি তার। প্রেমহীনতায় ভুক্তভুগী কামরোগীরা দেহ ও বিছানা অবিরত ধামসিয়ে চলে শান্তি অন্বেশণে। নড়ে চড়ে ওঠে খাট। খাঁচায় ডানা ঝাপটায় নেপাল থেকে আসা সুমানের পোষা পাহাড়ি টিয়া...অবশেষে কৃষ্ণগহবরে বীর্যপাত...প্রথম গনিকালয়ে আসা বিফল প্রেমিকের ক্লান্ত শরীর জুড়ে তখন বিষাদ-মাখা হর্ষ, নিরাশক্তির হাঁসি ঠোঁটের কোণে! আর এইভাবে গনিকালয়ের ইঁটের ঠেক্‌না দেওয়া খাটিয়া হয়ে যায় স্টীল রডে ঘেরা, সাদা চাদরে মোড়া হস্পিটাল বেড!

এক রাশ ব্রেক-অয়েলের গন্ধ ছড়িয়ে অবশেষে ট্রেন থামে স্টেশনে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কিছু মানুষ বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে দ্রুত স্টেশনে নামে। বাড়ি ফিরে যেতেও অসুবিধে হয় না কারণ এ তল্লাটে অভাবী রিক্সা অথবা ভ্যান চালকের অভাব নেই। স্টেশনের ধারে ওই ঝুপড়িটায় থাকে ছেনো, বিল্টু আর ওদের পোষা বেঁজী বাদশা। প্লাস্টিক দিয়ে দেওয়াল আর ছাদ, রেল লাইনের দিকে দর্জা; পাশ দিয়ে ট্রেন গেলে ধাঁই করে খুলে যায় আর তখন বাদশা ঘর থেকে বেরিয়েও যেতে পারে। তাই খুব সাবধানে থাকতে হয় ওদের। খোকা সবে হাঁটতে শিখলে বাড়ির লোকজনদের যেমন কাজ বেড়ে যায়, অনেকটা সেই রকমই। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার অনেক আগেই টের পেয়ে যায় ছেনো; মেঝে মৃদু কাঁপতে শুরু করে, শরীরে আরাম লাগে...তারপর কাঁপুনি বাড়তে থাকেখোলাম কুচিদের নাচিয়ে, সমান্তরাল রেল লাইনগুলোকে গতির গুঁতোয় গুলিয়ে, বিরহ-মিলন দোলায় দুলিয়ে লৌহ-দানব স্টেশনে প্রবেশ করে। হুইসেলের ভয়ানক শব্দের আক্রমণ এড়াবার জন্য ছেনো, বিল্টু এমন কি বাদশাও সর্বদা কানে তুলো গুঁজে বসে থাকে। ট্রেন থামলে ছেনো এক, দুই গোনে অথবা ঝট করে ট্রেন ছাড়ার আগেই একটা বিড়ি ধরায় কিংবা বাদশাকে আলতো করে পাঁচটা চাঁটা মেরে নেয়। এসব হল ছেনোর খেলা, ট্রেনের সাথে কথোপকথন। একঘেয়েমিকে সায়েস্তা করার এক প্রকার প্রয়াস। তবে গভীর রাতে যখন ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের চিৎকার তুলো ভেদ করে কানে ঢুকে পড়ে, এদিকে বিল্টুর জ্বর আর এলাকায় সাপও কমে আসছে, এসব চিন্তারা যখন মাথায় কিলবিল করতে থাকে, তখন ছেনো গোনা অথবা চাঁটা মারার আগে অদৃশ্য ঈশ্বর অথবা নিয়তির সঙ্গে বাজি ধরে – “ যদি ট্রেন ছাড়ার আগেই কুড়িবার শ্বাস নিতে পারি, তবে কালই বিল্টুর জ্বর সেরে যাবে, ধেড়ে ধেড়ে ঢোঁড়া সাপ মিলবে মুন্সিদের বাগানে......” খেলা আর খেলা থাকে না, রাতের দুশ্চিন্তার দুরভিসন্ধিতে খেলা বিবর্তিত হয় ব্যক্তিগত সংস্কারে; কুড়ি গোনার পরে তিনটে চারটে অতিরিক্ত নিঃশ্বাসও নিয়ে নেয় ছেনো, তার যা বিদ্যে...কুড়ি অব্ধি অত তারাতাড়ি গুনতে গিয়ে দু-তিনটে সঙ্গখ্যা তো বাদ পড়ে গেলেও যেতে পারে। সাবধানের মার নেই; তুকটা ঠিকঠাক নামাতে পেরে সন্তুষ্টির হাঁসি ছেনোর চোখে মুখে...ঝুপড়িতে আলো নেই বলে নেহাত দেখা যাচ্ছে না। হুইসেল বেজে ওঠে, চাকার তপ্ত ঘর্ষণে রেল-লাইন হয় মসৃনতর। ওই লাইনের মতোই গরম বিল্টুর কপাল। তুক হল, রেল গেল, জ্বর তবু নামে না। হাঁপের টানে হারিয়ে যায় ছেনোর দীর্ঘশ্বাস, পরম মমতাভরে হাত বুলিয়ে দেয় দেয় বোনের কপালে, বাদশার ঘাড়ে পিঠে। ট্রেনের শব্দ শুনে সে মনে মনে ছক করে – ‘মালগাড়ি! শালা কয়লার ওয়াগান! ইরফানরা বেলচা নিয়ে উঠে পড়েছে ট্রেনে...এতক্ষণে লাইনের দুধারে কয়লা ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে!’ সকাল হলেই এলাকার অভাগারা দিনের আলোয় কয়লা কুড়োতে বেরোবে, মাইলকে মাইল ট্রেন সামলে হাঁটবে, হামা টানবে, তারপর বস্তায় কয়লা ভরে ইরফানদের কাছে জমা দিয়ে দিন মজুরি বুঝে নেবে। ছেনোকে তাই ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রেন থেকে ঘোরানো টর্চবাতি আর সাপের মোকাবেলা করার জন্য বাদশাকে নিয়ে কয়লা কুড়োতে বেরোতে হবে। ভয়ে কচি কলজে ধুকপুক করছে। তবে উপায় কি? দড়ি হাঁটিয়েদের ছেলেবেলার খেলা অথবা তালিম তো এমনই হয়!

আঁধার নামলে সব স্টেশনই সুন্দরী হয়ে ওঠে। হাতে গুণে ট্রেন থামে, এমন স্টেশনও রাতে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলোয় স্বপ্ন হয়ে যায়। খালি বেঞ্চ, হলুদের ওপর কালো দিয়ে লেখা বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিতে স্টেশনের নাম, রেল লাইনের ধারে প্ল্যাটফোর্মের গোড়ায় ‘রাম নারায়ণ রাম’ অথবা ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’, পানের পিক মাখা বালি ভরা লোহার বালতি, কার-সেডের ধারে আবর্জনা ও আগাছায় ঘেরা পরিত্যক্ত কামরার কঙ্কাল আর আবছা ওভার-ব্রীজ ঘোর লাগিয়ে দেয়...অতি পরিচিত প্ল্যাটফর্ম নির্জনতার সাথে মিলে মিশে অচেনা হয়ে যায়। ওয়েটিং রুমেরা হাঁ করে বসে থাকে মানুষের অপেক্ষায়। তবে রোজ যারা নানাবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে এই চত্তরে ঘুরে বেড়ায়, তাদের ভীষণ চেনা এই শুন্য প্ল্যাটফর্ম, ঝুলে ভরা ওভার-ব্রীজের ছাদ, খাট হয়ে যাওয়া চা অথবা খবরের কাগজের ঠেলা গাড়ি অথবা পেঁচোয় পাওয়া পোয়াতী পাগলীনির নিত্য প্রলাপ – সব, সব কিছুই ভীষণ পরিচিত...তাদের কাছে রাতের স্টেশন শুধু সুন্দরীই নয়, পরম স্নেহময়ী জননীও বটে। স্টেশন মায়ের জাত, রাত জেগে সন্তানদের আগলে রাখে; স্টেশন কখনো ঘুমায় না, স্টেশন কাউকে ফেরায় না।

এদিকে নেপাল থেকে আসা নবাগতা সুমান সারারাত ভালোবেসে, ক্লান্ত দেহে বিছানায় অবশেষে শরীর এলিয়ে দেয়। একটা কোকিল সেই কখন থেকে ডেকেই চলেছে। মন খারাপ হয়ে যায় সুমানের, ভয় করে তার; ঘুম উড়ে যায় অদৃশ্য অষ্পৃশ্য অসুখ আতঙ্কে। তখন সুমান জানলা বন্ধ করে বার করে তার ট্রাঙ্ক। চাবি খুলে জামা কাপড় সরিয়ে বার করে তার অতি প্রিয় বিদেশী ডল পুতুল। ওঃ কতোদিন ডিম্পিকে ভালো করে আদর করা হয়নি! অনর্গল কথা বলে চলে ডিম্পির সাথে। ডিম্পির মান ভাঙ্গায়, চুল আঁচড়ে দেয়, ঝুঁটি বাঁধে রাবার ব্যান্ড দিয়ে। সস্নেহে পরিয়ে দেয় নতুন ফ্রক। তারপর হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে যায় সুমান, ডিম্পিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এক কোনে; কাজল পেন্সিল আর নেল পালিস দিয়ে সযত্নে কাঁচা হাতে, অচেনা অক্ষরে ঘরের দেয়ালে বারবার করে লিখতে থাকে তার পাহাড়ি প্রেমিকের নাম। সুমানের চোখ ফেটে জল বেরোলেও বাইরে তখনও আলো ফোটেনি।

ঘুম অবশেষে ভাঙে – শরীরটা একটা পুরোনো ভেজা ন্যাতা হয়ে গেছে – কাপড়ের খাঁজে খাঁজে চিটে খয়েরী ময়লা – ন্যাতাটা কোন এক কালে সাদা ছিল, তারপর ঘষা খেয়ে খেয়ে, বুট আর সময়ের ধুলো যা মেঝে, বিছানা অথবা শরীরের তোয়াক্কা না করে এমনিই প্রতিনিয়ত প্রলেপ তৈরি করে, সেই সব মহাকালের মিহি মেমেন্টোরা পেশীর দ্রুত সঞ্চালনায় এই ন্যাতায় এঁটে বসেছে। হাজার কেজি নিরমা, সার্ফ অথবা কস্টিক সোডা-ও এই ময়লা একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। ন্যাতা গলে তুলোর ঘ্যাঁট পাকিয়ে যাবে তবু তার খয়েরী দাঁত বেরিয়েই থাকবে। তবে প্রতিদিন যদি ভোরের কচি কুসুমের ছোঁইয়াচ লাগা ঠান্ডা ঝরণার জলে ন্যাতাটার গা স্পঞ্জ করে দেওয়া যায় তবে নাকি এক-দুশো বছরের মাথায় সাদা ফুটে বেরোয়!

ঘুমত না হয় ভাঙ্গলো, কিন্তু শরীর তো এক চুলও নড়তে চায় না। পিঁচুটি মাখা ঘোলাটে চোখ বন্ধ পাখাটার দিকে ঠায় তাকিয়ে। ঝিমে ভেজা শারীরিক কষ্ট ছাড়া কোন দুঃখ, আনন্দ বা উত্তেজনা মগজে নেই। মগজের সার্কিটের যে সব তারের চান্স কনট্যাক্টে এইসব অনুভুতিমালার জন্ম হয় সেই সব তার এখন খয়েরি জঙের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে; যা ধকল গেছে গত তিন মাস! ফ্যানের ব্লেডের ধার বরাবর জমা দৈত্যাকার শুঁয়ো পোকার মতো ময়লা বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে – আশ্চর্য্য! ফুল স্পিডে বনবনিয়ে ঘোরার সময় অহংকারী পাখাটা কেমন শরীরের ক্লেদ ময়লা সব লুকিয়ে রাখে। আর পুট করে সুইচটা বন্ধ করলেই ধরা পড়ে যায় আর ছাদ আঁকড়ে আবহমান কাল ধরে ঝুলতেই থাকে!দৃষ্টি না সরার জন্য মৃদু বিরক্তির এক ঝিলিক যেন খেললো বলে মনে হল। যাক একটা কাজ পাওয়া গেছে। মগজের অলিতে গলিতে বিরক্তিটাকে খুঁজতে বেরলো সে। পথের দুধারে এলো মেলো শব্দেরা পড়ে আছে। কয়েকটা মোড়ে তারা নিজেদের বিন্যাস বিভিন্ন রকম ভাবে সাজিয়ে চিন্তা তৈরি করার চেষ্টা করছে। তবে ঠিকঠাক হচ্ছে না – রাত জাগা শব্দেরা এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে, বাক্য এলোমেলো করে ব্যাকারণের খিল্লি ওড়াচ্ছে। অল্প পরিশ্রমেই হা৬পায় সে, বুক ধড়ফড় করে, ‘দোর বোকচোদ, কোন চুলোয় যে লুকিয়েছে বিরক্তিটা’ আর কথাটা ভাবতে না ভাবতেই আরেকটা নতুন বিরক্তির জন্ম হয়। এবার আর বিলম্ব না করেই বিরক্তিটার টুঁটি টিপে হেঁচড়ে পেঁচড়ে, থাঙ্কুনি পাতার মত কচলিয়ে বিবর্ধিত করে, তবু উঠতে ইচ্ছে করে না – কটা বাজে? ঘরে একটা ঘড়ি আছে। বেশ মনে পড়ছে গত রাতে ঘড়ির টিক টিক সে শুনেছে আর তার সাথে তাল মিলিয়ে মনে মনে টিকটিক আবৃত্তি করে সময় কাটাবার চেষ্টা করছিল। আই বল এদিক ওদিক করে সে ঘড়িটাকে খোঁজে আর দু চোখে বেয়াড়া অশ্রু দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়। চোখের জলটা আঙ্গুলে নিয়ে একটু চেখে দেখে সে, না তেমন নোনতা তো নয়। ওই, ওইতো ঘড়ি। সোয়া তিনটে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। হাত, পা খিঁচে আছে, চোয়াল শক্ত। ফ্যাঁচ করে একতু নাক ঝেড়ে নেয়। কোথায় মোছা যায়? হাত, পায়ে ঘসে শুকিয়ে নেবে? নাঃ, চ্যাট চ্যাট করবে, চামড়ায় লোম আটকে যাবে। বাথরুমটাও তো চেনে না সে। অগত্যা বিছানার চাদরে হাতটা মুছে নেয়। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘষে ব্যাপারটা লুকোবার চেষ্টাও করে সে। নাকে একটা বাসি আপেলের গন্ধ সেই কখন থেকে লেগে রয়েছে। ওঃ! গতকাল রাতে ও আধখানা আপেল খেয়েছিল। persistence of odour? তাও এতক্ষণ! বেশ অবাক লাগলো। আচ্ছা আপেলের গন্ধের রঙ কি লাল? না এটার অন্তত নয় – এটা, এটা,...চপ্পলের শব্দ – কেউ আসছে, আসছে কেউ! মৃদু আনন্দ আর উত্তেজনা; কত লোকই তো এসেছে, গল্প করেছে, থেকেছে তার কাছে – মানব সান্নিধ্যের উষ্ণতা আর আনন্দ নতুন করে উপলব্ধি করে সে – চেনা কেউ হলে ভালো হয়। আশায় আশায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

না, কেউ আসেনি ওর ঘরে। আর তো পারা যায় না। কর্মহীনতা, আলস্য আর শারীরিক অসুস্থতা ক্রমে অসহনীয় হয়ে ওঠে। রাত শেষ হবো হবো করছে। বেপরোয়া ট্রাকেরাই অন্ধকার হাইওয়ের নৈশ-শাসক; রাতের শেষ কনভয় শহরে ঢুকলো বলে। একটু পরেই সুর্য্য উঠবে...রোদ ক্রমে কড়া হবে...রোদের প্রতিনিয়ত ঘর্ষণে হাইওয়ে পরিনত হবে এক বিশাল রাংতায় আর যানবাহনেরা হয়ে যাবে বাদামী ধুলো। ধনতন্ত্রের ভুত নল টানবে, তাড়া করবে ইচ্ছে মতো...অস্তিত্য বিষ্মৃত মোহাচ্ছন্ন মানুষেরা সেই তাড়া খেয়ে আশ্রয় নেবে ইতালীয় চামড়ায় মোড়া, কার পারফিউমের সুবাস বিশিষ্ট, কালো কাঁচে ঢাকা শীত কোটোরে। ততক্ষণে অবশ্য শেষ হয়ে যাবে ছেনোর কয়লা অন্বেশনের নৈশ-অভিযান...মাছ ধরার ডিঙিরা তখন মাঝ নদীতে। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার এক গ্রীষ্মকালীন ভোরের কথা...অতি আকাঙ্ক্ষিত সুদীর্ঘ গরমের ছুটির মাঝামাঝি মন কেঁদে উঠেছিল স্কুলের বন্ধুদের দেখার জন্য, বিশেষ করে তিয়াশাকে। জীবনের ঊষালগ্নে কোথায় কলরবে মেতে ওঠার সেই অদম্য ইচ্ছা মচ্‌কে দিয়েছিল কচি হৃৎপিন্ড; ভীষণ খাঁটি সেই ইচ্ছে টিউমর হয়ে গলা টিপে ধরেছিল ভেতর থেকে; মনে হয়েছিল – ‘ইস! যদি কেউ ক্যালেন্ডার থেকে সব লাল রঙ চুরি করে নিত তাহলে কি মজাই না হতো!

আর বেশি দেরি নেই, পূবের আকাশ রাঙা হল বলে। জামাইয়ের চায়ের দোকান খুলে গেছে। ওইতো জামাই তার আড়াইখানা কাঠি ভরা সিপ দেশলাইটাকে সযত্নে স্টোভের আঁচে সেঁকে নিচ্ছে। রাত জাগা ছেলে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। চেনা পথঘাট, বন্ধ দোকানের সারি আর ঘুমন্ত বারান্দাগুলোকে অপরিচিত মনে হয়; ভোরের ঘোরে আচ্ছন্ন আত্মবিষ্মৃত বালক আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করতে চায়। আবার নতুন করে পেতে চায় জণ-অরণ্যের উষ্ণ উপস্থিতি। এখনই হয়তো বা আয়োনেস্কোর সেই অবিস্মরণীয় উপলব্ধি পুণোরুচ্চারণ করার যথার্থ সময় –

‘As I woke up one morning from my nocturnal as well as mental sleep of routine, everything appeared strange as well as familiar. When this astonishment of being invaded me, I thought this feeling belongs to all men of all time.’

এখন হাঁটতে বেরিয়ে রাস্তায় প্রথম দেখা লোকটিকে তোমার জীবনের সব চেয়ে গোপন কথাটা বলে দিলে রক্ত উলটো পথে ছুটতে শুরু করবে – আয়ু বৃদ্ধি পাবে। তবে এখন আর কথা নয়, সময় বিশেষে নীরবতাও গান হয়ে যায়। দেখো ভালো করে – আকাশ ফিকে হতে হতে এখন আকাশ আর কমলা হ্যালোজেনের আলো এক হয়ে মিলে মিশে যাচ্ছে...আবহমান কাল ধরে দন্ডায়মান পত্রবিহীন বৃক্ষসারী তাদের আজন্মের বাসনা নিয়ে আকাশের দিকে শাখা প্রশাখা বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কুসুমপানা মুখ করা আগুনে শিশুকে আঁকড়ে ধরবে বলে; যদিও তাদের শিকড় ঈগলের নখ হয়ে জমি আঁকড়ে রেখেছে। বাসনা আর নিরাশক্তির দ্বৈরথে কেটে যায় এক অথবা একাধিক জীবন – ময়দানে গ্রীষ্মকালের কদাচিত কুয়াশার আস্তরণ চাদর হয়ে আগলে রাখে বৃদ্ধ বেওয়ারিশ ঘোড়ার লাস...এমন মিহি মোলায়েম আলোয় কতটাই বা তফাত বলো রক্তিম পলাশের নির্যাসে আর পেশাদার প্রেমিকের রক্তে? এহেন দুর্লভ সন্ধিক্ষণে নত জানু হয়ে চোখ না বুজে উপায় থাকে না।
My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন