• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • ভাবনালেখা লেখাভাবনা


    কবিতা নিয়ে গদ্য। কবিতা এবং গদ্যের ভেদরেখাকে প্রশ্ন করতেই এই বিভাগটির অবতারণা। পাঠক এবং কবির ভেদরেখাকেও।


    সম্পাদনায় - অনিমিখ পাত্র
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

গীতা চট্টোপাধ্যায়



........গীতা চট্টোপাধ্যায়.......

(কাব্যগ্রন্থ-‘গৌরীচাঁপা নদী চন্দরা’,’সপ্ত দিবানিশি কলকাতা’,

‘মীনাঙ্ক সোপান’,’বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস’)



“কবিরা গ্যালারীর সবচেয়ে নিচু ধাপে বসেন”। যেন একধরনের ধূসর আলখাল্লা পরিহিত সূত্রধর একধরনের কোরাস বাদক যিনি তার দৃষ্টিকে অভ্যস্ত করছেন যাপনের সর্বোচ্চ গ্যালারীর অভাবটির সাথে আবহসংগীতটির সাথে। ভাঙাগড়ার সাথে।লক্ষ্য করছেন জাগতিক ‘মীনাঙ্ক সোপান’ থেকে কীভাবে ঝনঝন শব্দে ভেঙে আসছে অগণিত সময়তট । একটা অবশ আর্ত সিম্ফনি। আর এখানেই তার মানস প্রস্তুতিতে তার প্রকৃত প্রস্তাবনায় আমরা লক্ষ্য করতে পারি একটা দ্বিতীয় অস্তিত্ব। যা দৃশ্য থেকে ক্রমাগত দুলে দুলে ভেসে চলেছে দর্শণে; এক ধরনের ধারাবাহিক বিশ্বতৃষ্ণা নিয়ে প্রশ্ন করে চলেছেন কবি! পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে নেমে পড়ছেন পৃথিবীর মানচিত্রে।এ প্রশ্ন থেকে তাকে কখনই আলাদা করা যাচ্ছেনা , ঠিক যেমন আলাদা করা যাচ্ছেনা গীতা চট্টোপাধ্যায়কে তার কবিতার রূপরসগন্দের মত চলোর্মি জীবনবিন্দু থেকে। সেখানে শব্দের পীত ফুল নুয়ে পড়েছে ছায়ায়, সেখানে নীল পাখি ঠান্ডা ভারী বোবা একা উড়ে চলছে নিহিত নির্জন শূন্যতায়।গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কাছে এলেই ‘পথ’ এবং ‘পিছুটান’ এই দুটো শব্দের পারস্পরিক প্রতিলিপি গঠন চোখে পড়ার মত। একবার তিনি বলছেন-“নদীকূল ছাড়ে গাছ/ আর সেই গাছ ছাড়ে পাখি/ আমারও তেমনি যাওয়া, ধ্বংসের কিনারে বসে থাকি’আবার পরক্ষণেই দুটি অন্ধ চোখে ধরতে চাইছেন কার হাত ,থেকে যেতে চাইছেন সুন্দর প্রমাদে। এক ধরনের আবৃত চক্ষু নিয়ে অন্তরাবৃত্তির পথ ধরছেন কবি; পাঠকের সাথে সেখানে সারাদিনের লুকোচুরি খেলা ; জগৎস্থিত সত্তার মাঝে সারাদিন গড়িয়ে দিচ্ছেন চেতনাস্থ লালবল।সেখান থেকেই ফেরার ডাক দিচ্ছেন কবি। শাশ্বত পিপাসার মাঝে প্রতিমূহূর্তের প্রবাসী কেউ বলে উঠছে-“ পৃথিবীর কাছাকাছি একজন নিয়ে যাও কেউ,/ আমার সমস্ত মন জানলায় রয়েছে দাঁড়িয়ে”। হ্যাঁ , এই ফেরা তাঁর স্বরূপের ব্যাখায় ফেরা, খাঁটি স্বদেশে ফেরা। কি সেই কবির স্বদেশ? যেখান থেকে ‘ভিজতে ভিজতে চলে যাচ্ছে ভবঘুরে এক প্রকান্ড বেদে’।যেখানে আত্মকেন্দ্রিক ‘আমি’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরার্থ সত্তায় মেতেছেন কবি। ধরা পড়ছে তাঁর গোপন আকুতি- “ ডাকো/ ওকে ডাকো স্রোতে যে ভেসেছে ডাকো/ স্রোতের ওপরে হাত তুলে ডাকো ওকে/ও গতি ভীষন কোথায় চলেছে অপরিচিত/......ডাকো , ডাকো ওকে স্রোতে যে ভেসেছে, থামাও”।গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সামগ্রিক মূল্যায়নে একমাত্র “বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গইতিহাস” কাব্যগ্রন্থ ব্যতীত তার অন্যান্য কাব্যসংকলে শব্দের কাঠামোয় ভাগবত বা পৌরানিক প্রাকভূমিকাটুকু বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় অথচ তা কেবল বৌদ্ধিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ নয় বরং তার মাঝেও রয়েছে বিশ্বচিন্তা তার ভেতরেও রয়েছে ভোরের আলোয় ঘরে ছেড়ে দেওয়ার দুঃখ কিংবা হলুদবনে নাকছাবি হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতিমেদুরতা। আর এখানেই কি নিঁখুত জীবন্ত তাঁর কবিতা, এখানেই জীবন সংযোজিত হচ্ছে জায়মানে। একই সাথে অসংলগ্ন ব্যথার মতন অসহায়ের খেয়ায় ওঠছেন কবি আবার অপরাহ্নের রক্তিম আলোয় যে ফিরছে তার জন্য আঁচলে নাগালিঙ্গমের চারা নিয়ে ফিরে ফিরে আসছেন। প্রাণতার কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়, তাঁর ব্রত পাঠকের স্মৃতির সাথে সখার যোজনগন্ধা আতর মেশানো ...

মহাভিনিষ্ক্রমণ
(মীনাঙ্ক সোপান কাব্যগ্রন্থের প্রথম দীর্ঘ কবিতা)                                                

দিব্যাঙ্গনার গান

হে দূর পর্বত, আমি মেদুর মেঘের তলে দেবদারু শাখার আড়ালে
নীরঞ্জনা নদীতীরে এককানি ধ্যানাবিষ্ট নির্জন মন্দির রেখে যাই ।
করুণ গোধূলি-মেঘে নন্দনার মন্দগতি চন্দনার ঝাঁক উড়ে গেলে
বুদ্ধের বন্দনা ওঠে, চন্দনের গন্ধে তবু করুণা সুজাতা ফেরে নাই ।

[ ছাদহীন পার্বত্য গুহা। রুদ্ধদ্বার কক্ষে মৃতজ্যোৎস্না গোলক রচনা করেছে । তিনদিকে নিরেট কালো দেয়াল, দেয়ালে কৃষ্ণপ্রস্তরের একটি বুদ্ধমূর্তি। আবহে জ্যোৎস্নালোকিত তৃণভূমির একটানা মৃদু ঝিল্লিরব ।]

দার্শণিকঃ                   একবার , একবারই আলো, তারপর সব অন্ধকার !
                            একবারই দেখা, একবার মুখোমুখি ভালবাসা,
                            একবারই নগ্নবুকে স্বচ্ছ প্রদীপের আলো ধরা,
                            ডানার উত্তাপ থেকে জন্মান্তরের স্বপ্ন-সঞ্চয়ন,
                            ভীষণ উল্লাসে ওড়া সূর্যের সংঘাতে
                            শরীরিনী প্রপাতের প্রগাঢ় প্রদেশে উত্তরণ,
                            মাতাল সমুদ্র ঘুরে বকের পাখার সঞ্চালনে
                            ঘূর্ণিস্রোতে মজ্জমান স্মৃতির অতীত আর
                                      স্বপ্নময় দূর ভবিষ্যৎ ।
                                                [দরজায় প্রথম করাঘাত]
                                      তারপর শূণ্য বালুচরে শূণ্য হওয়া,
                            আকাশের অন্ধকারে নিষ্প্রদীপ গ্রহের খঁকাসের
                                      মহাশূণ্য পার হওয়া,
                                      ক্লান্ত হওয়া, জীর্ণ হওয়া,


                            প্রেমহীন তমসায় জ্যোতিহীন বধিরতা হওয়া,
          মৃত হওয়া,
          অন্তহীন শেষ হয়ে যাওয়া ।
তারপরই মরে পাখি, ছিন্ন পালকের কুয়াশায়
সূর্যাস্তের মেঘপুঞ্জ- রাশি রাশি মৃত্যু-পরিহাস !
          [দরজায় দ্বিতীয় করাঘাত]
          নিত্য নেই, ক্ষণ আছে –
          দণ্ডপল শতদল ফোটে
          ক্ষণ-বুদবুদের পরিখায় ।
আগত ও অনাগত, অতিক্রান্ত কালে
          শিরীষের স্বল্প গন্ধ,
          শিশিরের গান,
          সুদূর মধুর স্মৃতি,
          নম্র নিকেতন ।
পাহাড়ী সূর্যাস্ত শোভা, ক্ষণদীপ্ত শিখর-উদ্ভাস
          চলচ্চিত্র এই সব
বিশাল অরণ্যে ঢাকে সন্ধ্যার রোমশ অন্ধকার ।
          গন্ধ নয়, গান নয়,
          নব নব রেখাঙ্কন নয়,
          স্থিরোদ্ধত মহামূঢ় গূঢ় যবনিকা,
          নিপট নির্বাণ, নাস্তি;
          দীপ-নির্বাপণ ।   

[ দরজায় তৃতীয় করাঘাত ও দ্বার উন্মোচন। নারীর প্রবেশ, হাতে পঞ্চপ্রদীপ -]

দার্শনিকঃ    কে তুমি?
                            মৃত্যুর মেয়ে
                                                মেদুর দামিনী ?

                ক্ষণিক
                            মদির স্বাদে
                                                জয়তী বসুধা?

নারীঃ                      আমি সুজাত সুজাতা ।
দার্শনিকঃ                  বুদ্ধের সুজাতা?
সুজাতাঃ                    নানা জাতকের যাতায়াতে
                                      অগন্য বুদ্ধের স্রোতে
                                                অনন্ত সুজাতা ।

দার্শনিকঃ                  এও এক মিথ্যা-সরোবরে
                            চিত্রিত দেয়াল-পদ্ম
                            আমি মুগ্ধ চিত্রভৃঙ্গ নই ।

[ দার্শণিক অবজ্ঞায় পিছন ফিরে দাঁড়ায়। পঞ্চপ্রদীপ হাতে সুজাতা ফিরে যায়। দ্বার রুদ্ধ হয়। একা কক্ষে দার্শণিক সুজাতার পরিত্যক্ত স্থলটুকুতে এসে দাঁড়ালো, কবরীচ্যুত একটি পদ্ম মাটি ঠেকে কুড়িয়ে তোলে; তার আঘ্রাণ নিয়ে -]

দার্শনিকঃ                  চিত্রিত দেয়াল-পদ্ম চিত্রেই মেলায়,
                            অথচ এ গন্ধটুকু অবচেতনাও পার হয় ।
                            সমস্ত সহজ থেকে সমস্ত দুর্বোধ্যতার পারে
                            এই মুহুর্তের থেকে গত মূহুর্তের বেদনায়
                            আগামীর সম্ভাবনা সর্বত্র ছড়ায়,
                                      কেমন প্রগাঢ় করে !

[ক্ষণপরে ]
                            এরও নাম ক্ষণঘ্রাতা ক্ষণিকা-অপ্সরা
                                                ক্ষণস্বর্গে সঞ্চারিনী
                                                          ক্ষীণমধ্যা ......

[পুনরায় দ্বার-উদঘাটন । বিদ্যুদ্বতী নারীর আবির্ভাব, নাগফণি-দীপের আলোয় রেখায় রেখায় উগ্রা। দার্শনিক চোখ আবৃত করে, হাত থেকে খসে পড়ে পদ্ম -]

দার্শণিকঃ                   লোলবহ্নি মারকন্যা তুমি ?
নারীঃ                      সুতনুকা দেবদাসী আমি ।

দার্শনিকঃ                  [ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে] বারাঙ্গনা ?
সুতনুকাঃ                  বরাঙ্গনা সুতনুকা, বিরাট বুদ্ধের
                            বিশাল ছায়ার তলে নিষ্ফল আধের
                            দগ্ধ করি দীনপ্রান্ত সংসারের তীরে,
                            শুচি করি জাতকের অমল প্রত্যুষ, পদ্ম।

দার্শনিকঃ                  [তাচ্ছিল্যে] সূদূর অমল পদ্ম!
                            [ব্যগ্রতায়]
                            আপাতত দিতে পারো পদ্মভূমি-
                            এতটুকু পদ্মের মৃণাল?
                            আমার দ্বাদশ বিশ্ব ক্ষণিকের স্রোতে ভাসমান,
                            চূর্ণ চূর্ণ বলয়ের মুখে বিদ্ধ
                            বোধি, বীণা, বানী ও বেদনা ।
                            রূপ নয়, সংজ্ঞা নয়, প্রেম?
                            সেও নয় ।
                            ভীষণ ঝড়ের মুখে ছিন্নভিন্ন
                            স্বরচিত সংসার সমাজ;
                            ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রিয় ,
                            নরনারী, পিপাসা ও সুখ,
                            ইন্দ্র ও উর্বশী,
                            সরস্বতী, পার্বতী-পরম,
                            দুর্বার নাস্তির নীরে সদা ‘নাই’ ‘নাই’ –
                            কোথায় আস্তিক নীড়ে
                            প্রথম প্রণব !
                            এতটুকু ভূমি দিতে পারো
                            বরাঙ্গনা বক্ষের বিশ্বাস ?
                            সুদূর অমল প দ্ম!
                            দিতে পারো এতটুকু পদ্মের মৃণাল ;
                            আমার ছায়াকে নিয়ে
                            আরো কিছু দাঁড়াবার ঋণ ?

সুতনুকাঃ                             পারি,
                                      দিতে পারি,
                                      পদ্মের মৃনালভূমি – আরো কিছুক্ষণ
                                      স্থিরমূর্তি সময়ের স্রোত
                                      নিটোল বেদনাময় দ্যুতি
                                      প্রেম ও বিশ্বাস
                                      স্মৃতি ও ঈশ্বর !

দার্শনিকঃ                   কোথায়?  কখন ??
সুতনুকাঃ                   এইখানে। নিত্যবর্তমানে ।

[ পূর্ণ-উন্মুক্ত দ্বারপথে বাইরের উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে দার্শনিকের হাত ধরে নিয়ে যায় সুতনুকা। শারদ জ্যোৎস্নার পূর্ণকুম্ভ ভেসে যাচ্ছে বনে বনান্তরে, শস্যক্ষেত্রে, পাহাড়ে , উপত্যকায়। বাঁশি বাজছে অরণ্যলতার কুঞ্জে কুঞ্জে। দার্শনিকের হাত ধরে সারারাত ঘুরে বেড়ায় সে। শেষে পৌঁছোয় এক খরস্রোতা নদীর কূলে। উপলখন্ডে শ্রান্তদেহ রেখে দার্শনিকের কোলে মাথা রাখে সুতনুকা ।]

দার্শনিকঃ                   সুতনুকা, বরাঙ্গনা ...
সুতনুকাঃ                   আর কথা নয়। জানো নাকি
                            কথারা স্মারক –
                            ক্ষণজীবী মানুষের ভীরুতাবশত
                            সময়ের মুখ চেয়ে
                            প্রাণপণ সমাধিচনা?            
                            অনুভব ... শুধু অনুভব ,
                            তার চেয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ
                            আর নেই ...

দার্শনিকঃ                  সুতনুকা,শুধু একবার,
                            একবার বলো, ভালবাসো ...

সুতনুকাঃ                  ভালবাসা অনুভব নয়,
                            মূহূর্তের অনুদীপ্ত বেদনা-বুদ্বুদ
                            ভালবাসা স্মৃতির সুরভি-
                            নেপথ্যে বাজায় বাঁশি,
                            রঙ্গমঞ্চ তখন নির্বাক ।

দার্শনিকঃ                  জানি না মূহূর্তসীমা,
                            বর্তমান-অতীতের সীমারেখাময়
                            অস্তিত্ব ও স্মৃতির বলয় ।
                            শুধু অনুভব করি,
                            ক্ষণের বুদ্বুদে
                            পদ্ম এসে লাগে বুকে,
                            গন্ধ ঢেকে দেয়
                            আমূল চৈতন্যভূমিঃ
                            এরই নাম প্রেম ।
                            সুতনুকা , দারুময়ী
                            পাষাণহৃদয়া ,
                            এই জ্যোৎস্না ব্যাপ্ত করে
                            একবার বলো ‘ভালবাসি’-
                            নদীর ওপার থেকে কুন্ডলী কুয়াশা
                            এখনি প্রোজ্জ্বল চাঁদ করে নেবে গ্রাস,
                            সমস্ত পাখিরা এক  ভীষণ চিৎকার
                            বুঝি বা এখনি করে ভোরের আকাশ উন্মোচিত ।

সুতনুকাঃ                  দেখো তো নদীতে সেতু বাঁধা হলো কি না?
দার্শনিকঃ                  সুতনুকা, একবার, একবার বলো ......
সুতনুকাঃ                  [আত্মমগ্ন] কারা যেন সেতু বাঁধে দারুণ নদীতে ...
দার্শনিকঃ                  সুতনুকা, পাষাণহৃদয়া ...
সুতনুকাঃ                  [ব্যগ্র হয়ে] দেখো দেখো পালের নৌকায়
                            কারা যেন এইপারে দূরন্ত গতিতে
                            ছুটে আসে দিগ্বিজয়ী !

দার্শনিকঃ                  সুতনুকা ... সুতনুকা!
                            ভরাপাল নৌকা নয় –
                            কী ভীষণ বরুণ-সেনানী!
                            উন্মুক্ত কৃপাণ –
                            ত্র্যম্বকের অট্টহাসি যেন!
                            ঝড়ের মেঘের পুচ্ছে-অশ্বকেশ !
                            সমুদ্রফেনায়-স্বেদ বিন্দু !
                            ক্ষুরোৎক্ষিপ্ত বিদ্যুৎ- আকাশে !!!        

সুতনুকাঃ                  রক্ষা করো রক্ষা করো
                            প্রেমিক, দয়িত,
                            জীবনবল্লভ,
                            আমাকে হরণ করে নিয়ে যায়
                            নিষ্ঠুর সেনায় !

দার্শনিকঃ                  [অসহায় হয়ে]
                            সুতনুকা, প্রেমিকা, প্রেয়সী,
                            শেষবার শুনে যাও-
                            আমি ছেড়ে দিইনি তোমাকে,
                            ওরাই নিয়েছে কেড়ে,
                            ওরা অগণিত
                            দুর্ধর্ষ নদীর সেনা –

সুতনুকাঃ                  সময়  ......সময়  ......

[তরঙ্গে  সুতনুকা  মিলিয়ে  যায়। মুহ্যমান দার্শনিকের দৃষ্টি হঠাৎ পড়ে সুতনুকার পরিত্যক্ত চেলাঞ্চলে, ছুটে গিয়ে বুকে ধারণ করে সে ।]

 দার্শনিকঃ                 শোনো শোনো অগণ্য তারকা,
                            শোনো চন্দ্রভূমি,
                            নদীর দারুণ সেনা, শোনো,
                            সুতনুকা নাম তার,
                            আমি ভালবেসেছি তাকেই।
                            আকাশের মতো সেই বিশালক্ষী
                            চন্দ্রের মহিমা নিয়ে
                            এসেছিলো সফল শরতে।
                            নক্ষত্রের পদ্মরাজি
                            সুদীর্ঘ আলোর রেখা ঘিরে
                            আমার দেহের প্রতি রোমকূপে
                            করেছে প্রকাশ
                            পুষ্পবন, ব্যথাঘেরা উপত্যকা,
                            প্রেমের প্রান্তর ।
                            ঝর্ণার মতন দেহে আলিঙ্গনে
                            স্বর্গের বল্কল
                            মন্দাকিনীস্রোতে চ্যুত শতদল হয়ে
                            পেয়েছে গম্ভীরনাদী মন্দিরের তট ।

                            সেখানে পদ্মের দলে
                            এতদিনে পেয়েছি মৃণাল-
                            আমার ছায়াকে নিয়ে এতটউকু দাঁড়াবার ভূমি,
                            অতীত ও বর্তমান, ভবিষ্যৎ-
                            ত্রিকোণ-প্রমিতি;
                                  স্মৃতি !
                              এইখানে সুতনুকা আছে,
                   ঈশ্বর আছেন।

[বহুদূর থেকে পূজারতির ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে, নদীতীর বেয়ে আসতে থাকে এক নারী- হাতে পঞ্চপ্রদীপ।]

দার্শনিক ছুটে যায় তার কাছে। ব্যগ্রতাবশত চেলাঞ্চল খসে পড়ে উপলখন্ডে ]

দার্শনিকঃ                  কে তুমি? আমার সুতনুকা?
                            দেবদাসী, দেবতার দূতী-
                            অনন্তের সান্তর সজনি?

নারীঃ                      আমি সুজাত সুজাতা।
                            নানা জাতকের যাতায়াতে
                            অনাদি বুদ্ধের স্রোতে
                            অনন্ত সুজাতা ।

দার্শনিকঃ                  [চরম হতাশায়] কি দেবে সুজাতা? স্মৃতি?
সুজাতাঃ                    সে তো আরো সুতনুকা দেবে ।
দার্শনিকঃ                  সুতনুকা একজনই।

সুজাতাঃ                    সুতনুকা অগণ্য অশেষ ।
                            স্মৃতি থেকে স্মৃতির বিলয়,
                            অগ্নি থেকে অগ্নিচক্রে
                            একই আবর্তন ।
                            এক থেকে একাধিক সুতনুকা-
                            ক্রমপর্যটন ।

দার্শনিকঃ                  না, না, না, না ।
                            শেষ সত্য স্মৃতি-
                            সে-ই তো ঈশ্বর,
                            সে আমার সুতনুকা ।

সুজাতাঃ                    এসো এই নদীর কিনারে,
                            দেখ চেয়ে চন্দ্রমণি জলে,
                            কি দেখো প্রত্যেক ঢেউয়ে ?
দার্শনিকঃ                  সুতনুকা, সুতনুকা ভাসে-
                            কোটি কোটি সুতনুকা-মুখ !
                            নারী!
                            তুমি যাদুকরী ...
                            নির্দয় পেষণে
                            তোমার মন্ত্রের গুপ্তকক্ষ চূর্ণ করে
                            দুর্জয় স্মৃতির মধ্যে জীর্ণ হয়ে যাবো ...

[সুজাতার দিকে উন্মাদের মতো ধাবমান। অচপল সুজাতা ইঙ্গিতে তাকে স্থির হতে বলে, পঞ্চপ্রদীপের শিখায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে-]
সুজাতা;                    দেখ এর প্রতিটি শিখায় ...
দার্শনিকঃ                  [স্তব্ধ হয়ে]
                            অগণ্য শিখায় জলে অসংখ্য সুজাতা।
                            [চোখে হাত চাপা দিয়ে নতজানু হয়ে প্রার্থণার ভঙ্গিতে]
                            সুজাতা ! সুজাতা !
                            অন্ধকার ... বড়ো অন্ধকার !!
সুজাতাঃ                    স্মৃতিরা কি কথা বলে?
দার্শনিকঃ                  এখন স্মৃতিও অন্ধকার !
সুজাতাঃ                    সুতরাং সময় হয়েছে ...
দার্শনিকঃ                  কিসের সময়?
সুজাতাঃ                    স্মৃতি থেকে নিষ্ক্রমণ ।
                            এসো হাত ধরো ।
দার্শনিকঃ                  [হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়]
                            কোথায় চলেছো নিয়ে?
সুজাতাঃ                    প্রশ্ন করো না ।
দার্শনিকঃ                  বেশ। চলো, সুজাত সুজাতা ।

[অল্প অল্প ভোরের আলো ফুটতে থাকে, পাখিরা গান গেয়ে ওঠে, পঞ্চপ্রদীপ হাতে সুজাতা দার্শনিককে নিয়ে উষাভাসের দিকে মিলিয়ে যায় -]

দিব্যাঙ্গনার গান

না, কোনো মৃত্যু-প্রস্থানভূমি নয়,
না, কোনো জাতক-উপজাত লোকালয় ।
না, কোনো চেতনা-মূর্ছিত যন্ত্রনা ।
না, কোনো হর্ষ হৃদয়ের হিল্লোল ।

এ শুধু তিমির, এ শুধু তিমিরযন্ত্রনা,
কৃশবেদনার আতপে আলোর মার্জনা,
স্বয়ংবুদ্ধ বোধি-দ্রুমে জাগে শর্বরী –
নীরঞ্জনায় তিমিরাধিকের কল্লোল ।।

...........................(যবনিকা)...........................


পিপীলিকা ও তৃণকীট

‘হে ঘাসের পোকা, তুমি সমস্ত শরৎকাল কি করে কাটালে?’
‘আলস্য করিনি আমি অবিশ্রাম গান গেয়ে কাটিয়েছি বেলা !’
‘তাহলে এবার শীত কেবল নৃত্যের তালে কাটালেই পারো ...’
বিষয়ী, তোমার ওই উপদেশ মনে থাকে, তবুও থাকে না ।
চারিদিকে শরবন প্যারিসের অপেরার কুহকনিশ্বাস
বাতিগুলি শনশন উচ্ছ্বসিত করতালি রাতভর ওড়ে
নদীর ভিতরে গান অর্কেষ্ট্রার অতি মৃদু চাবি খুলে যায়
বিরাট ব্যাঞ্জোর খাদ পাহাড়ের নির্জনতা গোধুলি গড়ানো
এই শাদা ফেনাময় দেহ নিয়ে শরতের বাতাসের ভেসেছি
অনায়াস ভঙ্গিমায় কী যে শ্রম ছিল এক পাভলোভা জানেন
পদাঙ্গুলি ‘পরে দেহ বিন্যস্ত যৌবনভার নিরালম্ব স্থির !

বসে আছো তুমি সঙ্গী নতজানু, তুলে দুটি অস্পষ্ট অধর,
আমার কোমরবন্ধে শুধু মৃদু কাতরতা স্পর্শের পুলক-
বাকী সব দেহ নিয়ে দেহের আক্ষেপ নিয়ে রাজহংসী নাচে
পাভলোভা জানেন সারা শরতের রৌদ্রদিন আলস্যে রাখিনি ।

পিয়াৎসা ফোয়ারা তবু ঝরে ঝরে একদিন ফুরোবে সময়
করুণ বেহালা ঠেকে নাট্যশেষে আবহের, রাজহংসী শোনে,
বাঁকা ঘাড়ে পড়ে তার নির্সগের শেষ জ্যোৎস্না মায়াবী বিক্ষেপে
জটিল ধ্রুপদী মুদ্রা শীত এসে কেড়ে নেবে সর্বাঙ্গসুন্দর
সঙ্গীর হাতের থেকে ক্ষীন কটি আনন্দের অনিদ্র মুদ্রণ।
মুমুর্ষ হংসীর ডানা একবার প্রসারিত ঝরেছে পালক
বাগানে পপির দৃশ্যে শরতের সমারোহ শেষ বিন্দু শোক ।

বিষয়ী, তোমার ওই উপদেশ তবু মনে থাকে না শিল্পীর,
এই শরতের মধ্যে রাজহংসী নেচে যায়, জাগো শরবন ।

পূর্বমেঘে উত্তরমেঘে

চলো আজ চলে যাই নির্বিন্ধ্যার তরল কল্লোলে
বেত্রবতী কতদূর? বলাকারা উড়ে গেল বুঝি !
কেতকীর লোধ্ররেণু বনিতার ললিত কপোলে,
শিপ্রায় তাদের মুখ পান্ডুচ্ছায় উপবনে খুঁজি ।
বিসকিশলয় মুখে বলাকারা আজ পথ ভোলে,
সানুমান আম্রকূটে প্রেক্ষণীর বপ্রক্রীড়া রুচি,
হরিৎ-কপিশ নীপ পুলকিত পূরবৈঁয়া দোলে,
গ্রামচৈত্যে যুথিজাল-গন্ধবতী পাদরাগে শুচি।

কুটজ কুসুমে আজ মেঘদূত পাঠাবো না তবে,
শুধু দেখে চলে যাবো গোপবেশ বিষ্ণুর ময়ূখ,
রুদ্ধালোক রাজপথে কনক-নিকষা সৌদামিনী ।
ভবন-শিখীর দল জাগাবো না কলহাস্যরবে;
বিদিশায় নিশিক্লান্ত সুপ্ত সব গৃহবলিভুক-
কেশসংস্কার-ধূপে কবেকার স্মৃতি উজ্জয়িনী ।
সরস্বতী হয়ে মুছি ব্রহ্মাবর্ত – বিক্ষত আহবে;
রত্নচ্ছায়-দেবালয়ে সন্ধ্যারাগে মহাকাল-মূখ
দেখে যাবো- গম্ভীরায় জীবনের বিশীর্না তটিনী ;
তখন পড়ে কি মনে দূর অলকার সীমন্তনী ?

কোকিল ও চন্দরা

অষ্টাদশ বসন্তের ছায়াপথে একক কোকিল
জ্যোৎস্না বা তাপের দিনে ডেকে যায় যাদের জীবনে,
তারাজানে সঙ্গিহীন প্রতীক্ষার নিরালা অঙ্গনে
বড়ো আপনার কেউ বসে আছে; অদৃশ্য অনিল
সেখানে ঝিলের জলে মহুয়ার পরাগে সমিল ।
সুন্দর পরায় মালা, বৃথা প্রয়োজনে আভরণে ;
কোকিল বিতৃষ্ণ যদি পৃথিবীর শ্লথ আবরণে,
চন্দরা অন্তরা মেয়ে, ডুব দে রে- নিষণ্ণ নিখিল !

আজ কেন দ্বারে এসে ডেকে গেল কোকিলের স্বর,
মধ্যাহ্ন অলস চূড়ে চূর্ণ হলো মদির মলয়,
গৌরীচাঁপা নদী আর চন্দরার চকিত নূপূর
নিষন্ন নিখিলে যেন কার শব্দে হয়েছে মূখর ।
ও পোড়া পরাণ, তুই ধিকি ধিকি সূর্যের বলয়,
কোথায় ঢাকি যে তোকে মধ্যরোদে অসহ্য ত্রিচূড় !

ও নষ্ট কোকিল, তোর এখানে কি খুইয়ে স্বঘর?
কাঁচের আকাশের ঝিলে বাঁধালি রে কী খন্ড প্রলয় !
অষ্টাদশ বসন্তের খরতাপে কোকিলের সুর
বড়ই নিদয়া কার কথা দিয়ে ভরেছে দুপুর ।




গুহালিপি

গুহার দুধারে সাদা হরিণের স্বদেশ স্বরাজ ;
দেবদারু ছায়াসিক্ত গিরিপথে মৃদু শিলাজতু,
এখানে যজ্ঞের ভাগ ফেলে গেছে তৃপ্ত শতক্রতু –
উদ্বৃত্ত স্বর্ণের ভারে আনমিত শস্যের সমাজ ।
গুহার ভিতরে যজ্ঞ গন্ধর্বের সূক্ষ কারুকাজ ;
সুতনুকা দেবদাসী, বারাণসী জনপদবধূ,
একাদশতনু আর অত নুর ধনুর বেপথু,
প্রকোষ্ঠের রন্ধ্রপথে কিশোর, কিন্নর,নটরাজ ।

পর্বতে এখনো আলো, বনে বনে ঘন অন্ধকার,
গুহাচিত্র স্পর্শ করে নক্ষত্রমালিনী নিশীথিনী –
বাসনা বিজয় আর বৈরাগ্যের সমাধিভবন ।
কন্দর্পদীপকে ম্লান মদনের নব-উজ্জীবন ,
চারুলোভী দানবের শিবিরে ইন্দ্রের অনীকিনী ,
একাকী পিনাকী তাঁর বুকে বিণ্ণ অনাদি ওঙ্কার !
প্রতিহত মহাদ্রুমে সারসের নিশীথ ক্রেংকার,
মৃগের বিহারভূমি পরিপ্লুত মূল প্রসবিনী ।
হৃদয়ের গুহালিপি সিক্ত করে সজল পবন –
নটরাজ নৃত্য করে, অস্তধূমে অনাথ গগন !

লোডশেডিং

কোথায় যে বেজে যায়  ওই এক ফোন অন্ধকারে
এ টেবিল থেকে আরো টেবিলে, টেবিল ঘুরে ফিরে
এই কাছে ওই দূরে আরো দূরে দূরে কতক্ষণ
অন্ধকার ঘরে একা বেজে চলে সেই এক ফোন ।

পাশ ঘেঁষে উড়ে যায় পর্দার দূরন্ত নীল পাল
নক্ষত্রের মতো ওড়ে বইয়ের অজস্র ঝোড়ো পাতা
ফুলে ফেঁপে পাটাতনে  মশারির তরঙ্গ তুফান
কোথায় ভেড়াবে বলো এ-ক্লান্ত নাবিক পোতযান ।

ফুলদানি থেকে ফুল ঝরে গেছে, দ্বীপের সবুজ,
রেডিয়াম ডায়ালের সঙ্গে খসে পড়েছে কম্পাস
কোথাও জীবন নেই আলবাট্রস পাখির মতন ,
চিহ্নহারা অন্ধকারে নিশীথে তোমার ওই ফোন ।

কর্তার ঘোড়া দেখে রাসসুন্দরী

উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া
কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী
যদি দেখে ফেলে সেই ঘোড়ার ভিতরে অধিকারী
অবাধ আলোয় দেহ এক-উঠোন ধানের সন্তোষে ?
আমি যে দেখি নি তাঁকে কখনো রৌদ্রের দুঃসাহসে !

স্তিমিত রাত্রির খাটে ঘনবর্ষা পিছল দর্শন –
জোনাকিকাঁটার খোঁপা, শেষ আলো, তাও নির্বাপণ !
ঝিঁঝির অস্পষ্ট দেহ শব্দময় হবে কত আর
কোরা শাড়িটির সুখ আতরের লজ্জায় মরেছে ।
আলপনার গন্ডিটানা সেই এক আড়-অন্ধকার
পালঙ্গে পরম শুয়ে, রুপোর জাঁতিটি রাঙাধুতি
প্রথম দিনের মতো শুধু এক ধূসর আকুতি
ঘোমটার মায়াবী সুতো ধরে যা রেখেছে পোড়াচোখ ...

বকুলফুলেরা জানে, দেখনহাসিরা সব জানে,
কখনো দেখি নি তাঁকে হাওয়ার নির্ভীক অকল্যাণে
এমন স্বচ্চন্দ আর অবাধ ঘোমটার পরপারে
নিলাজ নয়নে মেলে এক-উঠোন ধানের সংসারে ।

নষ্ট মধ্যাহ্নের বেলা রাশিরাশি ধানে যায় ভেসে
কর্তার প্রতিভূ ঘোড়া আঙিনার দুয়ার আটকিয়ে
দাঁড়িয়েছে সব ঢেকে তেরশো পাঁচের বাঙলাদেশে ।


ওষধিষু বনস্পতিষু

কি দেবে বৃক্ষ তুমি, তপঃসিদ্ধ আরো কোন আলো ?-
তোমার শিকড়ে ধারা প্রবাহিত নীল সিন্ধুনদ,
শিকারী হর্ষক্ষ মৃগ বৃকোদর শ্বেতাশ্ব দ্বিরদ,
সে স্রোতে এসেছে ভেসে ভিক্ষুক সন্ন্যাসী লোকপালও ।
রঙ্গন, নিবিড়তর রমনীর সংবিৎ রাঙালো
তোমার শোণিত রঙ রাত্রিজলে গাঢ় কোকনদ ;
গাঢ়তর গাত্রবাসে সঙ্ঘবাসী অনাথপিন্ডদ ,
‘আরো কোন আলো দেবে ?’- তপঃসিদ্ধ বৃক্ষকে শুধালো ।

অগ্নিহোমে-দ্যুতিময় সন্ধ্যামেঘে সায়ং-আহ্নিক
উজ্জ্বল ধ্যানের স্পর্শে সমাহিত শাখাগুলি ঋজু,
জ্যোতির্ময় সপ্তর্ষির আলোহিত আলোর আচমন ।
সংজ্ঞা থেকে বোধি থেকে কিছু শস্য করি আহরণ,
মেদমধ্য উপাস্থির অতিগূঢ় উপাদান কিছু,
সংগ্রহ করেছি শেষে পত্রমূলে বিনীত বার্নিক ।
সায়ন্তন বেদনায়- অথচ প্রশান্ত কারুণিক
বলেছেন, নত হও, এখানে নিশ্বাস করো নিচু !
শিল্পীর মুখের দাগে ভাঁজে ভাঁজে আত্মসংবরণ
এবং বৃক্ষের খাঁজে ‘ক্রমশ হওয়া’র উত্তরণ ।

অক্ষৌ নৌ মধুসংকাশে অনীকং নৌ সমঞ্জনম

ঝরনায় স্নান সেরে উঠলেন তরুন ঈশ্বর ।
বুকে রৌদ্র ক্ষৌমবাস, রজতাভ্র স্ফুরিতকুন্ডলে,
বামবাহু পুষ্পধারা,সুদক্ষিণ দৃঢ় আখন্ডলে –
অর্জুন ন্যগ্রোধ শালে শোভমান সমুচ্চ ভূধর ।
শিলায় শিলায় শুভ্র উৎসধারা স্ফটিক নির্ঝর
স্খলিত অঞ্জলিপুটে- অকস্মাৎ দেখেন শৈবলে
অঘন পিশুনবস্ত্রে আদিনারী লোহিত উপলে
ধীরন্যাসে উঠে আসে সপ্তসিন্ধু মথিত মকর !

কেশপাশে শীকরিত  সমুদ্রের আদিম মৌক্তিক,
মরকত তারকায় ইতস্তত বিজলী বিচ্যুত,
আগুলফ ব্রীড়ার ভারে নতোন্নত দ্রাক্ষার উদগম ।
আসিক্ত উল্লাসে গূঢ় সঞ্চরণে মায়া-কুরঙ্গম
বনান্ত ছায়ায় যেন বাপীতটে করেছে আপ্লুত
বিপ্রলব্ধ মৃগাজীব, সমরান্ত কাতর কৌন্তিক।
বায়ুলুব্ধ কম্প্রকেশে কৌতুহলে তাই অযৌক্তিক
ঈশ্বর আঘ্রাণ-তৃপ্ত, উল্লসিত পানে অভিযুত ।
সপ্তসিন্ধু আম্রেড়িত, আলোড়িত বাসনা-সংক্রম-
আন্দোলিতা আদিনারী,আমোদিত ডমরুমধ্যম ।


 তস্য ভাষা সর্বমিদং বিভাতি

তাঁর চরণের নীচে বসলাম নতজানু হয়ে ।
অজাতশত্রুর সেই পাদনখে বিনষ্ট অসূয়া ,
অঘমর্ষণের তটে পূত-শীলা গঙ্গাধারা ক্ষয়ে
করেছে দুখানি পদ অপরূপ নিবিড় গেরুয়া ।
শ্রাবণের হংসশ্রেনী মেঘের আবাসে রয়ে রয়ে
যেমন হ্রদের জলে রূপদক্ষ রঙের পটুয়া –
তেমনি রসের স্রোতে তুলিকায় ব্যথা বুকে বয়ে
তাঁর ইচ্ছা রক্তে রাখি নিগূঢ় আনন্দ চারুচুয়া ।

আমি কি শব্দের ঘ্রাণ কস্তুরীমৃগের মতো পাই!
নশ্বর বিশ্বের বুকে আমার বেদনা ধূপছায়া-
তিনি কি জানেন আমি তাঁর প্রেমে এমন বাতুল?
চন্দনদ্বীপের পথে চলে যেতে ভেঙেছে মাস্তুল ,
কালোজলে ফেনায়িত কবেকার কালিয়ের কায়া,
তবু স্থির পরিবেশে বয়ে যায় অন্তরে আত্রাই ।
কোথায় হরিণ নাচে, নিরীহসুন্দর নীলগাই-
শব্দের কিরণে ভাসে মানুষ-মানুষী, পরীমায়া !
পৃথিবী পুষ্পিত হয়, পূর্ণচাঁদ ক্রমশ রাতুল,
তার নামে ফুল্ল প্রেম, প্রেমিকের হৃদয় বকুল ।


***************


My Blogger Tricks

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন