সবাই বড় পুকুরের পাশে কাঁঠাল গাছটার তলায় জড়ো হয়েছে l এখনো ঝুলছে কমলির দেহটা, হাওয়াতে দুলছে মৃদু মৃদু l শেতল বাউড়ি একটু দুরে বসে l সত্যি, শেষতক কমলি যে ব্যাপারটা এত দুরে নিয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি শেতল l সবার সেই এক প্রশ্ন, কি হযেছিল শেষমেষ l নাও, বোঝাও এখন জনে জনে l আরে বাবা যার গেল তার গেল, এখন এই প্রতিজনকে এক কথা বলতে কার ভালো লাগে l পুলিশ আসার অপেক্ষায় সবাইl আজ ভোরে গাড়ু হাতে মাঠ পানে যাবার সময় হরেন বাগদি ব্যাপারটা দেখে ফেলে l গিয়ে শেতল কে টেনে তোলে ঘুম থেকে l সেই ইস্তক এখানেই .. এর মুখ ওর মুখ করে করে গ্রামের সব্বাই এখন এই কাঁঠাল গাছ তলায় l
অথচ শেতল তার বউ কে খুব আটকাঠের মধ্যে রাখত l লোকের সামনে বড় বেশি বার করত না l এখনো সুন্দর কমলি, লম্বা চুলটা খুলে পড়েছে, নাকের নোলকটায় প্রথম সুয্যির ছটা এসে পড়েছে, জিভটা বেরিয়ে এসেছে কিছুটা l সব্বাই দেখছে এখন কমলির ঝুলন্ত দেহটাকে l
ছি:!! ডুকরে উঠে শেতল মুখ ফিরিয়ে নেয় l
সেবার ওলাইচন্ডি উঠেছিল যেবার গ্রামে, সেই মেলার থেকে কিনে দিয়েছিল এই শাড়িটা বউকে l লাল ছাপের শাড়ি, বড্ড মানাত ওকে l শেতল দূর থেকে দেখত আর জ্বলে যেত, এই কমলিকে আর পাঁচ জনেও দেখবে কেন l এই তো সেবার, যেবার চড়ক এর সময় – ঝাপ দেখতে যাবার কথা ছিল বউ কে নিয়ে l ওই শাড়িটা পরেছিল বউ, মাথায় ডগডগ করছে সিঁদুর, বড় টিপ আর নাকে নোলক l সেদিন শেতল বাউড়ি চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘হারামজাদী মাগী, শখ দেখো না! কজন মরদকে নাচাতে যাচ্ছিস শুনি? মেলায় যাচ্ছিস না পালা করতে, বেজম্মার বেটি? আজ সেই কেষ্টঠাকুর-পালাগান-বাঁধা ছোড়াটা মেলায় আসবে বুঝি ?’ এক নিমেষে বিবর্ণ হয়ে গেছিল কমলির মুখটা l কিন্তু কিছুতেই বলতে পারেনি, এ সাজ শেতল এর সাথে মেলাতে যাবার আনন্দে সেজেছে কমলি l চেঁচিয়ে বলেছিল – ‘হা আসবেই তো, যত মরদ গুলান আমাকে দেখবে আর নেশা চাপবে ওদের, বউদের ফেলে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে ওরা, তবে না মজা? আমি যে আবাগীর বেটি গো l আমার এই সব ছেনালিপনা না করলে চলে?’
‘যাও আজ গেলুম না আর মেলাতে’ … শেতল লাফিয়ে ওঠে – ‘কি যাবি নি? আমার মেলায় যাবার সুযোগ নিয়ে মরদ আনবি ঘরে? ডাইনি মেয়েছেলে কোথাকার l’
এমনি সব ঘটনা … কমলি সয়ে নেয় দিনের পর দিন, আর স্বামীর জন্য ভাত রাঁধে, বক ফুল ভাজে, ডালে ভালো করে সম্বরা দেয় আর ভাবে, যখন শেতল শেষ ডাল টুক চুমুক দিয়ে ‘আহ’ শব্দ করে, খেয়ে উদ্গার তোলে, কি একটা ভালোলাগা যে হয় কমলির বুকে!
সেদিন রঞ্জনা আর তার নতুন বিয়ে করা বর গ্রামে এলো l রঞ্জনা কমলির সই l এসেই কত যে মিঠে মিঠে কথা নিজেদের সম্পক্কে বলল তার শেষ নেই l আর কমলির বুকটা জ্বলে গেল, পুড়ে গেল l চোখে জল এলো l সামলে নিয়ে শেতলের খাবার পরের হাসি হাসি মুখটা মনে করতে চেষ্টা করলো ও, মনে পড়ল না l ‘এই মেয়েছেলে, তু শিশুর বউকে বলেছিস, আমি তোকে কিছু দিই না, খেতে পরতেও দিই না ভালো করে?’ ‘কই না তো … এ কথা কখন বলেছি আমি’ – ‘আবার মিথ্যা বলা হচ্ছে? আজ তোকে বেঁধে রাখব দাঁড়া তোর্ পাড়ায় বেরোনো আমি বের করছি শালি – একটা কথা যদি কার সাথে কয়েচিশ তো তোর্ একদিন কি আমার একদিন … দাঁড়া ….’ কমলি ভয় পায় l কিন্তু মনে মনে ভাবতে বসে, কখন সে বলল?
মনে পড়ে, শিশুর বউ বলেছিল –
‘তোমার চুল আঠা সম্পু লাগাও না কেনে’
‘হা ওকে আনতে বলেছিলাম রে ভুলেই মেরে দিয়েছে, আবার বলতে হবে’
‘আমাকে তো যা বলি সব এনে দেয় হাট থেকে’
‘ও না ও ভুলে যায়’
… এই তো কথা l
প্রথম গর্ভ হবার খবরটা বর কে দেবার জন্য মুখিয়ে ছিল কমলি l আজ বলতেই হবে – অপেক্ষা করছিল, কখন ফেরে শেতল হাট থেকে l আজ বেলের পানা করে রেখেছে বাতাসা দিয়ে যখন খেয়ে যখন জিরোবে, তখনি জানাবে সুখবর টা l
‘কমলি রে এ এ এ এ এ এ এ এ এ’ … হাঁক শুনে বুক কেঁপে উঠলো যেন l মনি ছুতোর এর বোন্ টাও অমন বানিয়ে বলল!! ‘তোমার সম্বন্ধে কমলি এত বানিয়ে বলে কেন গা, তুমি এত্ত ভালো মানুষ’ বাস আর যায় কথা … দু পাত্তর পেটে পড়তেই শেতলের সওয়ামিপনা তিন গুন বেড়ে যায় l একটা চেলা কাঠ নিয়ে মারতে আসে কমলিকে l কমলি দুরে পালাতে গিয়ে পড়ে গেল পা মুড়ে… আর তখনি সেই অজানা ভয়টা তার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে, যদি কিছু হয়ে যায় l সে আর্তনাদ করে ওঠে – ‘ওগো মের না মের না … আমার বাচ্চাটা …’ ‘বাচ্চা?’ খেঁকিয়ে ওঠে শেতল … ‘ওসব বাচ্চাটাচ্চা আমারে দেখাস নে কমলি … কবে কোথাকার বাচ্চা, আগে বলিস নি ক্যান… বাচ্চা কি মাটি ফুঁড়ে বেরয় …’ সত্যি, কেন যে বলে নি কমলি… বলবে বলবে করেও … লোকটার যা রাগ, কি বলে বসে .. অথচ ও তো সঠিক জানে ও নিষ্পাপ … তার বাচ্চার বাপ ওই শেতল হতচ্ছাড়াই!
কমলি পড়ে আছে, তার দু পা বেয়ে শোণিত স্রোত l আজ হাতের সুখ করে নিয়েছে শেতল … বাচ্চা ? চেলা কাঠ দু খান …. হাসু ঠাকমা বাধা দিতে এসে বাড়ি খেয়ে ফিরে গেছে … শেতলের রাগ এর কাছে কে আসতে পারে ? তারপর আর এক পাইন্ট বিলিতি সাবড়ে টলতে টলতে বিছানায় … কমলি অনেক রাত অবধি নড়তে পারেনি … ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে দেহ, সেই অবস্থায় একটা ঘোরের মধ্যে ভোরের দিকে ঘৃনা, লজ্জা আর সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেছে একটা পুরনো শাড়ি নিয়ে কাঁঠাল গাছটার কাছে l যাবার আগে সখের শাড়িটা ফেলতে পারেনি, পরে নিয়েছে … নাকের নোলক খানও l স্বামীর সোহাগের নিশানী … সঙ্গে যাক, আর যেটা সবথেকে আদরের চিহ্ন … সেটি তো পেটে, এতক্ষণে শেষ l কমলি আর বাঁচে কি নিয়ে ?
ব্যাস?
আশ্চর্য্য!
এত্ত সহজ সরল নির্লিপ্ত একটি মেয়ের আত্মহত্যার কাহিনী ভাবলেন তো এটাকে … নাহ তা নয়, মার খেয়ে কমলি তখন হয়ে উঠেছে হিংস্র, পেটএর সন্তান কে মার খেতে দেখা আর নিজে মার খাওয়া কোনো মায়ের কাছেই তো এক নয় l সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কমলি l আর লোকটা যখন টলতে টলতে বেহেড হয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে তখন তার উপর এলো পাথারি বাড়ি চালাতে লাগলো উঠানের এক কোনে পড়ে থাকা একটা লাঠি দিয়ে l বেসামাল শেতল উফ মা গো বলে ঘুরে পড়ল l হুঁশ এলো তখন কমলির – হায় হায় এ আমি কি করে ফেললাম – ‘ওঠো ওগো ওঠো’ … চকিতে শেতল এর খাওয়ার পর হাসি মুখটা মনে পড়ল l তার ঘুমন্ত মুখটা মনে এলো l আর পাগলের মত তাকে নাড়া দিয়েও যখন সাড়া পেল না কমলি l তখনই যেতে উদ্যত হলো – শেষ করে দিতে নিজেকে l কমলি জানতেও পেল না স্বামী হত্যা সে করেনি l
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও শেতল এর মনে এলো – ‘ও মরলো কেন? তবে কি পাপ লুকোতে…? তবে কি ওই গান লেখা ছোড়াটাই ? নষ্ট মেয়েছেলে …. l ‘
চটকা ভাঙতেই শুনতে পেল … ‘সর সর সব, পুলিশ এসে পড়েছে l’
পড়তে পড়তে হারিয়েছিলাম সনাতন (!) অন্ধত্বের গুহায়। এ ছবি শুধু শেতল কমলির নয়, ৮০% মানুষের হতাশ যৌন ক্রীতদাসত্বের। অভিনন্দন অপর্ণা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সৌমিত্র, যথার্থ বলেছেন ....
উত্তরমুছুন