(ক্রমে আসিতেছে)
বিদ্যুৎলতা বটব্যাল (১)
গল্পঃ কাঠবাদামের গন্ধ
১।
পার্ক স্ট্রিটের ফ্লেভার্স অফ চায়নার দোতলায় সোমবার দুপুরের দিকে
ভিড় একটু কম থাকে। এসময়ে এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকে বেশ কিছু উচ্চ মধ্যবিত্ত
কপোত-কপোতি – বিবাহিত,
অবিবাহিত, বিবাহযোগ্য ও বিবাহবহির্ভূত। কে কোন
ক্যাটেগরির সেটা নজর করে দেখলে বুঝেও ফেলা যায় কখনো-কখনো। সমস্যা হল, আজকের এই কপোত-কপোতির সমাগমে এক জোড়াকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তারা কি
বিবাহিত না অবিবাহিত? নাকি বিবাহবহির্ভূত? এদের মধ্যে কি বনিবনা আছে, না নেই? এরা কি প্রথমবার দেখা করল, নাকি পুরনো পাপী? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ছেলেটি অফিস কেটেছে মনে হয়। নাহলে এই গরমে কেউ ফর্মাল পরে
রেস্তোঁরায় আসে না। সঙ্গে ল্যাপটপ ব্যাগও দেখা যাচ্ছে। বেশ ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট
চেহারা, মুখে আধো-গদগদ ভাব, বয়েস আন্দাজ বত্রিশ থেকে পয়ঁত্রিশ। অফিস কেটে কেউ বউ নিয়ে রেস্তোঁরায় আসে
না, সুতরাং বিবাহিত নয় এ পর্য্যন্ত বোঝা গেল। কিন্তু তারপর
মেয়েটার দিকে তাকাতেই সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কত যে এর বয়েস, আন্দাজ করা মুশকিল। রোগাটে, বেঁটেখাটো চেহারা। কাঁধ
পর্য্যন্ত স্টেপ-কাট চুল। কালো স্কার্ট, কালো টি-শার্ট,
কানে বেশ পুরনো আমলের রুপোর বড় বড় ঝুমকো, ঠোঁটে
গাঢ় লাল লিপস্টিক। মুখটা বেশ মিষ্টি, পানপাতা সদৃশ। একটু
আহ্লাদী ভাব। রঙ ফরসা। দূর থেকে দেখলে রাজারহাটের রাজকন্যে মনে হতেই পারে, যদিও দু’একটা খটকা থেকে যায়।
জামাকাপড় আদৌ দামী অথবা ফ্যাশনদুরস্ত নয়। পাশে এলিয়ে থাকা ঝোলাটা শতচ্ছিন্ন, সেটাও বেশ সন্দেহজনক। আবার কানের ঝুমকোটার দাম বেশ
ভালই হওয়ার কথা – অ্যান্টিক
শপ থেকে কেনা মনে হয়। তাও, এই টাইপের রাজকন্যেদের কতরকমই তো
খেয়ালখুশি থাকে।
সামনে বসে থাকা কর্পোরেট বাবুটির অস্বস্তিটা কিন্তু দূরবীন না
লাগিয়েও পরিস্কার বোঝা যাবে। সাড়ে তিন মিনিটে দু’বার সে রুমালটা পকেট থেকে বার করেছে, মুখ মুছেছে, এবং ফের পকেটস্থ
করেছে। রেস্তোঁরায় এসি বেশ জোরেই চলছে, আর মাসটা সেপ্টেম্বর।
রুমালের প্রয়োজন এত বেশী পড়ার কথা নয়। তবু পড়ছে, কারণ সামনে
বসে থাকা রাজকন্যেটি কথা বলছে না। যদি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে থাকত তাহলেও
নাহয় বোঝা যেত যে ভদকার ফ্লেভার পছন্দ হয়নি অথবা সেচুয়ান ল্যাম্বটা ঠিকমত সেদ্ধ
হয়নি। কিন্তু তাও না, সে তাকিয়ে আছে সোজা ছেলেটির দিকে। আর
সেটাই অস্বস্তির মূল কারণ।
মিনিট কুড়ি আগে ছেলেটি রেস্তোঁরায় ঢুকেছে। শাদি ডট কম-এর পার্সোনাল
রিপ্রেজেন্টেটিভ ফোনে তাকে জানিয়েছিল,
তার সম্ভাব্য কনে কখন আসবে ও কোথায় বসবে। “শি উইল বি ইন ব্ল্যাক, শি সেইড”। দেখা করার আগে কি একবারও ফোনে কথা বলা যেত না? রিপ্রেজেন্টেটিভের মাধ্যমে তাকে জানানো হয়েছিল,
মেয়েটি ফোন বা ইন্টারনেটে কমিউনিকেশন পছন্দ করে না। প্রাথমিকভাবে
মুখোমুখি দেখা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ছেলেটি বেশ অবাক হয়েছিল... এ যুগে ফোন বা ইন্টারনেট
পছন্দ করে না! এখন তো সবাই হোয়াটসঅ্যাপেই প্রেম করে... কিন্তু সে আর কথা বাড়ায়নি।
শাদি ডট কম-এর প্রোফাইল অনুযায়ী, মৃণ্ময়ীর বাবা নাকি তিনটে
কার শো’রুমের মালিক। কলকাতায়
দু’টো বারশো স্কোয়ারফিটের
ফ্ল্যাট, একটা
পৈত্রিক বাড়ি। আর মৃণ্ময়ী নাকি অক্সফোর্ড ফেরত। তিনটে ভাষা জানে। রাজেশ আর
উচ্চবাচ্য করেনি। এ মেয়ের ম্যাও কিছুদিন সামলাতে পারলেই জ্যাকপট। সত্যি কথা বলতে
কি, রোজ ঘুম থেকে উঠে থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্য্যন্ত বস-এর
চোখরাঙ্গানি আর পোষায় না। নিজের একটা ছোটখাটো কিছু...। প্লাস, উচ্চশিক্ষিত ঘরনী যখন বন্ধুবান্ধবদের সান্ধ্য-আসরে পাস্তা, চিজ-পকোড়া আর কষা মাংসের প্লেট নিয়ে আসবে, তখন যে
তার চেকনাই বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার বদলে যদি কিছুদিন
হবু বউয়ের আঁচল ধরে ঝুলতেই হয়... বিয়ের আগে পর্য্যন্তই তো। মৃন্ময়ী আবার একমাত্র
মেয়ে।
সুতরাং, রাজেশ
আজ অফিসে মুখ দেখিয়ে কেটে পড়েছে। সোজা পার্ক স্ট্রিট। গাড়িতেই একটু সাজুগুজু,
মানে সিগনালের লাল-সবুজের ফাঁকে বগলে দামী সুগন্ধীর মাঞ্জা। ‘ড্রেসড টু ইম্প্রেস’ হয়ে সে বেচারা প্রাথমিক আলাপেই কেত মেরে ফাটিয়ে
দেওয়ার সঙ্কল্প নিয়ে হড়বড় করে নিজের বায়ো-ডেটা দিয়ে, এক হাত
বাড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে মেনু তুলে নিয়েছে। কিন্তু টেবিলের উল্টোদিকে একজোড়া
নির্বিকার চোখ। সদ্য ঘুম-থেকে-ওঠা এক্সপ্রেশনলেস একটা মুখ। রাজেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে
হাত গুটিয়ে নেওয়াকালীনই ওয়েটার হাজির। “হোয়াট উড ইউ লাইক টু হ্যাভ,
মৃণ্ময়ী?” – রাজেশ প্রানপণে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। এবার
মেয়েটা হাত বাড়াল। ওর দিকে নয়, মেনুকার্ডটার দিকে।
“মিক্সড হাক্কা নুডলস,
টু প্লেটস, ওয়ান সেচুয়ান ল্যাম্ব, ওয়ান চিলি গার্লিক চিকেন, টু ব্লাডি মেরিস”। মেনুকার্ড টেবিলে ফেরৎ গেল। বাচ্চাদের মত রিনরিনে গলা, তিক্ষ্ণ, স্পষ্ট উচ্চারণ।
সেই থেকে রাজেশের দিকে তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টে। রাজেশ ভেবে পাচ্ছে না
কি করবে। ছবিতে সুন্দরীই মনে হয়েছিল। টেবিলে পৌঁছেও বেশ ঢলোঢলো কাটিং দেখতে লাগছিল
মেয়েটাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকানোর পর রাজেশের একটা অদ্ভূত অস্বস্তি হচ্ছে।
কেমন শীত শীত করছে। মেয়েটার চোখদু’টো – কি একটা
প্রবলেম আছে ওখানে। না... চোখ দু’টো বেশ স্বাভাবিক এমনিতে,
এমনকি বেশ সুন্দর... ওই যাকে বলে পটলচেরা। কিন্তু দৃষ্টিটা...
অসম্ভব ঠান্ডা। সামান্য একটু উষ্ণতাও নেই। একটা অদ্ভূত নির্লিপ্তি, যাকে হিংস্রতাও মনে হতে পারে। রাজেশের মনে হচ্ছিল একজোড়া ব্ল্যাক হোল ওর
দিকে হাঁ করে আছে। রাজেশের বেশ ভয় করছে। এখন মনে হচ্ছে... এখানে না এলেই হত।
কিন্তু ছবি দেখে তো কিছুই বোঝা যায়নি...। রাজেশ কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বেরচ্ছে না। রাজেশ
ডিস্কভারি চ্যানেল দেখার সুযোগ পায় না খুব একটা। দেখলে হয়ত ওর মনে হত, অজগর শিকারের চোখে চোখ রেখে ঠিক এভাবেই হিপনোটাইজ করে ফেলে না তো?
ইতিমধ্যে ওয়েটার হাজির খাবার নিয়ে। খাবার চলে আসা মাত্রই মেয়েটা ওর
অস্তিত্ব ভুলে গেল। পুরো মনযোগ খাবারে। দ্রুতগতিতে খাচ্ছে। কোনো মেয়েকে ওভাবে
বুভুক্ষুর মত খেতে রাজেশ কখনো দেখেনি। কনফিউশন আরো বাড়ল। কিন্তু রাজেশ তাও
উচ্চবাচ্য করল না। যতক্ষণ মেয়েটা খাচ্ছে,
রাজেশ টয়লেটে ঘুরে এল, চোখেমুখে জল দিল। বোঝাই
যাচ্ছে স্লাইট মাথার দোষ আছে। কিন্তু বড়লোকের মেয়েদের ওসব দোষ ধরতে নেই। অত পড়াশোনা
করলে মাথা বিগড়ে যাওয়ারই কথা। ওটা ট্রেনিং দিয়ে ঠিক করতে হবে। রাজেশ মনে মনে হাসল।
ও যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছেলে। জীবনে অনেক টেড়া মেয়েছেলে দেখেছে। এদের সিধে করতে
পারাটাও একটা আর্ট। বিয়েটা হোক।
টেবিলে ফিরে এসে রাজেশ লক্ষ করল মেয়েটার খাওয়া হয়ে গেছে। আবার তাকিয়ে
আছে ওর দিকে। নাঃ, এবার
বলটা নিজের কোর্টে টেনে আনা দরকার। এসে থেকে এক ঘন্টা হয়ে গেছে। ইয়ার্কি হচ্ছে?
রাজেশ গলা খাঁকারি দিল।
-
আমাদের আলাপটা সেরে নেওয়া উচিৎ... না? আই নো
অল অ্যাবাউট ইয়োর স্টাডিস... বাট হোয়াট ডু ইউ লাইক টু ডু ইন ইয়োর ফ্রি টাইম?
মেয়েটা বেশ
খানিক্ষণ চুপ। যখন রাজেশ ধরেই নিয়েছে উত্তর পাবে না, তখন ছোট্ট করে উত্তরটা এল।
-
আই লাইক টু কিল।
-
হোয়াট!!!??
-
র্যাটস।
-
ইউ... হোয়াট???!!
আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটা বলল, “আই লাইক টু কিল র্যাটস”।
রাজেশ আবার রুমাল বের করল। শালা... বলে কি?? হবি হল ইঁদুর মারা? বিবাহবার্ষিকীতে
কি র্যাট-কিল উপহার দেবে??!! পুরোপুরি নাটকেস... বড়লোক বাপ
অ্যাসাইলামে না দিয়ে জামাই খুঁজছে ডাম্প করার জন্য! রাজেশ জলের গেলাসটা ঢকঢক করে
শেষ করে হঠাৎ সন্দিগ্ধ হল। মেয়েটা ইচ্ছে করে ওকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে না তো?
হয়তো বিয়ে করতে চায় না... ভাগিয়ে দেওয়ার মতলব...? এই কিছুদিন আগেও মদ-সিগারেট-গাঁজা খাই বলে পাত্র ভাগানো যেত, কিন্তু আজকাল তো ওসব জলভাত... সবাই খায়। তাই বোধয় নতুন টেকনিক? রাজেশ ঠিক করল, যা থাকে কপালে, লড়ে যেতে হবে। ও হাসার চেষ্টা করল।
-
আর ইউ জোকিং?
-
আই ডোন্ট জোক।
-
ওক্কে... সো ইউ কিল র্যাটস... তারপর মরা ইঁদুর দিয়ে তুমি কি কর?
-
এক্সপেরিমেন্ট।
-
মানে?
-
ডাইসেকশন। দ্য অ্যানাটমি অফ র্যাটস। সিমিলার টু হিউম্যান বিয়িংস।
-
কিন্তু সে তো ডাক্তাররা করে... বা সায়েন্টিস্টরা... তুমি তো...
লিটারেচার...
-
সাইকলজি।
-
হ্যাঁ... মানে... ঐ আর কি...
মেয়েটা আবার চুপ। রাজেশ ভেবে পাচ্ছে না এবার কোন দিকে এগোবে। দূর
বাল... ডিরেক্ট কাজের কথায় যাওয়া যাক।
-
আচ্ছা... টেল মি ওয়ান থিং... তুমি বিয়ের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড তো?
-
ইয়াপ।
-
রাইট... গুড! তাহলে... হাউ উড ইউ লাইক ইওর হাসবেন্ড টু বি?
-
হি মাস্ট হ্যাভ আ হেলদি ডিক।
-
আ...হোয়াট??
-
আ ডিক। পেনিস।
-
পেনিস ??!! (রাজেশ চেঁচিয়ে ফেলেছে প্রায়। বেশ
কিছু লোক ঘুরে তাকাল।)
-
হোয়াই? ইজ দেয়ার সামথিং রং উইথ ইয়োরস?
-
এসব কি বলছটা কি? আমাকে নিয়ে মশকরা হচ্ছে??!!
হোয়াট আ বিচ !!!!
রাজেশের মুখটা একটা টসটসে টমেটোর আকার ধারণ করেছে। মেয়েটা এই প্রথম
একটু অবাক হওয়ার ভাব করল। এবং এই প্রথম বাংলায় কথা বলল।
-
আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? বিয়ের আলোচনায়
যৌনাঙ্গ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ে মূলত একটি ফ্যালিক রিচুয়াল। পুরো ব্যাপারটাই
তো যৌনাঙ্গ-কেন্দ্রিক। তাই না?
রাজেশ উঠে
পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা খপ করে ওর হাত চেপে ধরল। “দাঁড়ান...”।
রাজেশ আবার ভ্যাবাচাকা
খেয়ে গেল। কি রে বাবা... এতক্ষণ পুরোটা নাটক করছিল নাকি...! আমাকে পরীক্ষা করছিল??
মেয়েটার মুখে সেই ভাবলেশহীনতাটা আর নেই। বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে
এখন। যদিও এখনো ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে... কিন্তু... বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে
এবার...।
রাজেশ আবার বসে পড়তে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই মেয়েটা বলল – “বিলটা দিয়ে যান”।
২।
এতক্ষণ বল্টু ফ্লেভারস অফ চায়না-র উল্টোদিকে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কের
দোকানে বসে আয়েস করে গোল্ড ফ্লেকে সুখটান দিচ্ছিল। এমনিতে বিড়ির বেশী কিছু জোটে না, কিন্তু আজ বল্টু রাজা হয়ে গেছে। রাজুদা কড়কড়ে
পাঁচশোটা টাকা ধরিয়ে দিয়েছে রাহাখরচ বাবদ। ওর কাজ হল রাজুদার সঙ্গে যে মেয়েটা
বেরবে তাকে ফলো করা। যদি মেয়েটা রাজুদাকে বলে ওকে কোথাও ড্রপ করে দিতে, তাহলে সেই পর্য্যন্ত বল্টু ট্যাক্সিতে পিছু নেবে, তারপর
থেকে মেয়েটাকে ফলো করবে। ট্যাক্সিভাড়া রাজুদা আলাদা দিয়েছে। বাড়ি গেলে বাড়ি চিনে
আসবে, পাড়াটা বুঝে নেবে, হালকা খোঁজখবর
লাগাবে। মেয়েটার বাড়ি সল্ট লেক, রাজুদা বলেছে। পশ এলাকা। যদি
বাড়ি না গিয়ে অন্য কোথাও যায় তাহলে কোথায় গেল দেখে রাখবে। রাজুদা একদম ঠিক স্টেপ
নিয়েছে। আজকাল আগে থেকে খবর নিয়ে মাঠে নামা ভাল। এইসব বড়লোক বাড়ির বখাটে মাগীগুলো
বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পেট-ফেট বাধিয়ে ছাঁদনাতলায় বসতে চলে আসে। কেউটের জাত। এদের
দুধ-কলা খাওয়ানোর আগে বিষদাঁত ভাঙ্গা দরকার আছে। বল্টু বিষদাঁত ভাঙ্গার প্রক্রিয়ায়
রাজুদাকে, মানে রাজেশকে, প্রিলিমিনারি
ফিল্ডওয়ার্কে সাহায্য করছে। বদলে বেশ কিছুদিনের খোরাকি দিচ্ছে রাজুদা। বল্টু সকালে
রাজুদার গাড়ি ধোয়, আর বাকি দিনটা কখনো ফ্ল্যাটের দালালি,
কখনো গ্যারেজে পার্ট-টাইম কাজ, কখনো
ইলেকট্রিকাল মেরামতি। যখন যেমন পায়। সন্ধ্যের দিকে চোলাই। স্লাইট জুয়োর অভ্যেসও আছে
বল্টুর। ওইখানেই মার খেয়েছে বেচারা বেশ কয়েকবার। না খেতে পেয়ে মরতে বসেছিল। রাজুদা
হেল্প করেছে। বল্টু জান দিয়ে দেবে রাজুদার জন্য।
রেস্তোঁরার ভেতরে কি ঘটেছে বল্টুর জানার কথা নয়। শুধু দেখল রাজুদা
পড়ি-কি-মরি করে বেরিয়ে এল, গাড়িতে
উঠল, ধাঁ হয়ে গেল। যাব্বাবা ! কি হল কেসটা? একটু পরে দুলকি চালে মেয়েটা বেরল। বেশ পুতুল-পুতুল দেখতে তো? ডবকা ঠিক না... কিন্তু কিউট আছে। এগুলোকে চুদে আলাদা মজা... স্কুলের মাগী
মনে হয়। মেয়েটা ট্যাক্সি ডাকছে। কেসটা কি হল দেখতে হচ্ছে। বল্টুও সঙ্গে সঙ্গে আর
একটা ট্যাক্সি ডেকে ফেলল।
ট্যাক্সিতে
উঠে মৃণ্ময়ী ব্যাগ থেকে একটা সিল্ক কাটের প্যাকেট বের করল। খুলতে দেখা গেল, দু’টো আছে। সামান্য ঠোঁট ফোলাল। তারপর দেশলাই বের করে সে একখানা ধরিয়ে
ফেলল। দেশলাইয়ের অবস্থা আরো খারাপ। কাঠি ছিল ঠিক একটা।
অইদ্দ্যাখো... মেয়েটা স্মোক করছে! সাল্লা... কি মাল!! বল্টু একবার
ভাবল রাজুদাকে ফোন করে। তারপর ভাবল,
থাক... আগে পুরো সিনটা দেখি... তারপর রিপোর্ট।
এবার মৃণ্ময়ী নিজের ফোনটা বার করে পেছনের ফ্ল্যাপটা খুলে সিম
কার্ডটা টেনে বার করল। ব্যাগ থেকে বেরল একটা ছোট্ট কাঁচি। সিম কার্ডটা চার টুকরো
করল কাঁচি দিয়ে। তারপর ট্যাক্সির জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। ব্যাগের একটা খোপ
থেকে বেরল অন্য একটা সিম কার্ড। সেটা ফোনে ঢুকিয়ে ফেলল। ফোনটা অন করল। ইন্টারনেট
খুলল। প্রথমে শাদি ডট কম। ডিঅ্যাক্টিভট অ্যাকাউন্ট। তারপর ইমেল। ডিলিট অ্যাকাউন্ট।
তারপর ফেসবুক। পার্মানেন্ট ডিঅ্যাক্টিভেশন। এই অ্যাকাউন্টগুলো তিনবার ইউজ করা হয়ে
গেছে। তিনবারের বেশী স্ট্যাটিস্টিকালি রিস্কি।
বল্টু অবশ্য এর কিছুই দেখতে পেল না। শুধু দেখল, ট্যাক্সিটা মোটেও সল্ট লেকের দিকে যাচ্ছে না,
যাচ্ছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে।
মেয়েটা প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে নামল। বল্টুও নামল খানিক দূরে।
মালটা যাচ্ছে কোথায়? নাগরের
সঙ্গে অ্যাপো আছে? কিন্তু এখানে কোথায়? কফি হাউস নাকি?
মেয়েটা কিন্তু কফি হাউসের দিকে এগোচ্ছে না। অলিগলি ধরে যেদিকে
এগোচ্ছে, সে
যায়গাটা বল্টুর খুব চেনা যায়গা। এতটাই চেনা, যে বল্টুর
বিশ্বাস হতে চাইছে না যে মেয়েটা সেদিকেই এগোচ্ছে। বল্টু ভাবছে... রাজুদাকে একটা
ফোন করা দরকার... কিন্তু কেন যে করছে না সে নিজেও জানে না। মেয়েটা নো ডাউট ভদ্র
ঘরের... নাহলে রাজুদাই বুঝতে পারত... কিন্তু যাচ্ছেটা কোথায়!
মৃণ্ময়ী সোনাগাছিতে ঢুকে পড়েছে। বল্টু পিছু ছাড়েনি... কিন্তু এবার
বেশ ভয় ভয় করছে... এ কোন চক্কর রে বাবা! বল্টু এক মিনিট থেমে পকেট থেকে মোবাইল বার
করল। তারপরেই চোখ তুলে দেখে... মেয়েটা নেই। ভ্যানিশ। এই তো সামনেই ছিল... গেল
কোথায়?? ফ্যালফেলিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে
বল্টু রাজুদার নাম্বার ডায়াল করল। তিনবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রাজুদার খেঁকানি
শুনল – “কি হয়েছে?”
-
ও রাজুদা... এ তো চিজ গো একখানা... কোথায় এসে ঢুকেছে জানো...?
-
কোথায়?
-
সোনাগাছি গো...
-
কি????
-
সোনাগাছি...!!
-
শালা... দাঁড়া তো ! পুলিশে খবর দেব!
-
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও... এ ডেঞ্জারাস মাল...
কিস্যু বোঝা যায়নি... তোমাকেও ঘোল খাইয়ে দিল! কোত্থেকে কি ফালতু চক্করে পড়বে...
ছেড়ে দাও...
বলতে বলতে বল্টু পেছন ফিরে দেখল সে সোজা মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে
আছে। মেয়েটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে,
সেই নির্লিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে ওকে পেরেকের মত আটকে ফেলেছে। ফোনটা হাত
থেকে পড়ে গেল।
মেয়েটা
খুব সহজ ও মিষ্টি গলায় বলল – “খোচরগিরির পয়সায় তো গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট কিনেই
ফেলেছিস... বিড়ির প্যাকেটটা তো আর লাগছে না... ওটা আমাকে দিয়ে দে”।
বল্টুর নড়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু ওর হাতটা যেন নিজে থেকেই ওর
পকেট ঢুকে গিয়ে বিড়ির প্যাকেটটা বার করে এনে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিল।
পাশের দোকান থেকে একটা দেশলাই চেয়ে নিয়ে বিড়ি ধরাল বিদ্যুৎলতা
বটব্যাল। বল্টুর দিকে আর একবারও না ফিরে তাকিয়ে নাক বরাবর সোজা হাঁটা দিল
সোনাগাছির অন্তরালে।
৩।
প্রায় সব ছেলের মা-ই সম্বন্ধ দেখে। পুলিশের মা-ও দেখে। কিন্তু
নীলকন্ঠর মায়ের মত ম্যাট্রিয়ার্ক সব মা হয়ে উঠতে পারে না। সুতরাং নীলকন্ঠ, অর্থাৎ কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার নীলকন্ঠ চৌধুরী, মে মাসের হাড়-মাংস
গলিয়ে দেওয়া গরমে যখন চিৎপুরের একটা ব্যাঙ্কের ভল্টের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের
ঘামে হট শাওয়ার নিচ্ছিল, এবং ব্যাঙ্কের ভল্টের মধ্যে থেকে
যখন সদ্য বের করে আনা হয়েছে তার সহকর্মীর অর্ধমৃত বডি, এমনকি
তখনও সে সরলা চৌধুরীর নম্বরটা স্ক্রিনে দেখা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে Accept টিপল, কথা কি বিষয়ে হতে চলেছে সেটা জানা থাকা
সত্ত্বেও।
-
হ্যালো মা।
-
মেয়েটাকে কবে দেখতে যাবি?
-
যাব, মা। একদম সময় পাচ্ছি না। এই সপ্তাহের
মধ্যেই যাব।
-
এই সপ্তাহটা তো আজকেই শেষ হচ্ছে। আজ রবিবার।
-
ও... হ্যাঁ... না, মানে, আমি পরের সপ্তাহে তাহলে...
‘আমি এক কথা বলে আর এক কাজ করা পছন্দ করি না নীল’, সরলা দেবীর কথাগুলো ডীপ ফ্রিজের ভেতর থেকে আসছিল। ‘তুমি প্রথমে বলেছ এই সপ্তাহ। এখন বলছ পরের
সপ্তাহ। তোমার কথার কোনো দাম নেই নাকি?
এভাবে কথা বলা তোমাকে মানায় না। গোটা শহরের লোক তোমার ওপর ভরসা করে।
অথচ তুমি নিজের মা-কে দেওয়া কথাই রাখতে পারো না’।
নীলকন্ঠ যে ফাঁদটা দেখতে পায়নি তা নয়। পেয়েছিল। কিন্তু সময় মত পায়
নি। সে জানত যে তার মা জানেন ‘এই
সপ্তাহ’ কথাটা
সে কোনো কাজ এড়াতে হলে ব্যবহার করে। এটা যে তাকে ফাঁদে ফেলার সবচেয়ে সহজ উপায়
সেটাও তার জানা থাকার কথা, কারণ এভাবে সে বহুবার ফাঁদে পড়েছে
এযাবৎ। এতবার, যে এতদিনে তার ফাঁদটা বেশ ভালরকম চেনা হয়ে
যাওয়ার কথা। তবু, এতকিছু জানা সত্বেও, মস্তিষ্কের
রিফ্লেক্সটা সময়মত কাজ করল না। এটাই তার সমস্যা। টাইমিং। এই টাইমিং-এর গন্ডগোলে
বহুবার তার হাত থেকে সোজা-সাপ্টা কেস-ও ফসকে গেছে। যতক্ষনে সে ঠিক দিকে এগিয়েছে
ততক্ষনে পোস্ট মর্টেম হয়ে গেছে, এভিডেন্স হারিয়ে গেছে,
খুনি পালিয়ে গেছে, অপরাধী কেস জিতে গেছে এবং
নীলের উন্নতি আটকে গেছে। নিন্দুকে তাকে বোকা বললেও, সে জানে
সে বোকা নয়। কিন্তু সে যে বোকা নয় এটা বুঝতেও তার বেশ খানিকটা সময় লেগে গেছে।
ততদিনে ডিপার্টমেন্টে তাকে বোকা বলেই ধরে নিয়েছে সিনিয়ররা। উল্টোটা প্রমাণ করার
সুযোগ সে এখনো পায় নি।
তবু যে নীল ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে এখনো করে-কম্মে খাচ্ছে তার কারণ
খানিকটা তার রিটায়ার্ড ডিএসপি বাবা,
কিন্তু অনেকটাই তার গৃহবধূ মা। মায়ের সঙ্গে বুদ্ধির প্যাঁচ কষতে
কষতে বড় হতে হয়েছে নীলকে। কড়া গলা নয়, মারধর নয়, শাস্তি নয়, কান্নাকাটি নয়, স্রেফ
ঠান্ডা লজিক আর কূটবুদ্ধির জোরে সরলা চৌধুরী ছেলেকে, এবং
বরকেও, আঁচলের খুঁটে বেঁধে রেখেছেন। এখন বর রিটায়ার করে
অতিরিক্ত গৃহপালিত হয়ে পড়ার ফলে বোধয় আঁচলটা তাঁর হালকা লাগছে। যে নিজেই বাঁধা
পড়তে চায় তাকে বেঁধে রাখায় মজা নেই। তাই নীলের মায়ের একটি পুত্রবধূ সত্বর প্রয়োজন
হয়েছে।
তাই নীলকন্ঠ এও জানে যে ফাঁদটা আগে থেকে দেখতে পেলেও তার বিশেষ কিছু
করার ছিল না। সরলা চৌধুরী আজ পর্য্যন্ত কোনো খেলায় হারেননি। হঠাৎ নীল তাঁকে মাৎ
দিয়ে ফেলবে এতবড় দুরাশা সে রাখে না। কথা আর এগনোর আগেই সে বুঝতে পারল যে মায়ের ঠিক
করা মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে তাকে আজই যেতে হবে, যেহেতু সে বলেছিল এই সপ্তাহে যাবে, এবং আজই সপ্তাহটা শেষ হচ্ছে।
নীল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ে সে করবে না। সরলা চৌধুরী তার ওপর
মানসিক থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করলেও না। আর-একটি মিনি সরলা চৌধুরী ইন দ্য মেকিং, ব্যাপারটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। মেয়েদের
নীল পছন্দ করে না। ছোটবেলা থেকেই। অপছন্দের চেয়েও বেশী, ভয়
করে। মেয়েদের বুঝে ওঠা ইমপসিবল। এবং তাদের নিজের কথা বোঝানো আরো ইমপসিবল। এইরকম
ভয়ঙ্কর এক পিস প্রাণীকে নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা কাটাতে হবে – এই ব্যাপারটাই খুব থ্রেটেনিং। কিন্তু এই কথাটা
স্পষ্ট করে মাকে বলাও বেশ অসম্ভব। বলতে পারলে একমাত্র সম্ভাব্য পাত্রীটিকেই বলা সম্ভব।
এর আগে তিনবার সে বলেছে। দু’বার ব্যপারটা ভালই ম্যানেজ হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয়বার সে বেশ ফেঁশে
গিয়েছিল। মেয়েটি বলেছিল তার পক্ষেও না বলা সম্ভব না, কারণ তারও নাকি একটা গোলমেলে প্রেমের কেস আছে। না
বললেই বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ হয়ে যাবে, জোর করে বিয়ে দেওয়াও
হতে পারে। কে না বলবে এবং কিভাবে সেই নিয়ে যখন সে ফোনে মেয়েটির সঙ্গে তুমুল আলোচনা
করছে, এবং তার ফোন আসার ফ্রিকোয়েন্সিতে সরলা উত্তোরত্তোর
খুশি হয়ে উঠছেন অথচ তার নিজের কপালে ভাঁজ গভীর হচ্ছে, এমন
সময়ে একদিন সে মেয়েটির ফোন ধরে তার বাবার গলা শুনতে পেল। মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে
গিয়ে একজন নামকরা আর্টিস্টের বাড়িতে উঠেছে। নীলের মন স্বস্তিতে ফুরফুর করে উঠেছিল।
যদিও এক সপ্তাহ বাদেই তাকে মেয়েটির প্রেমিকের বাড়িতে হানা দিতে হয় পুলিশ অফিসার
হিসেবে, কারণ মেয়েটির ও তার প্রেমিকের ডেডবডি বাড়ির ছাদে
পাওয়া যায়। খুন ডেফিনিটলি, ছুরি দিয়ে গলার নলি কাটা হয়েছে।
দরজা ভেতর থেকে শক্ত করে বন্ধ। বারান্দা, ছাদ এবং সব জানলায়
গ্রিল লাগানো। খুনি বাড়িতে ঢুকল কিভাবে?
কোনো কিনারা না করতে পেরে সে যখন কেস বন্ধ করে দিয়েছে, তার বেশ কিছুদিন বাদে সকালে টয়লেট সীটে বসে কফিতে
প্রথম চুমুকটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীলের মনে হয় খুনটা মেয়েটির বাবা করিয়ে থাকতে
পারেন। খুনি বেল বাজিয়েই ঢুকেছিল। মেয়েটির বাবার ড্রাইভার একসময় খুনের দায়ে
গ্রেপ্তার হয়েও প্রমাণের অভাবে খালাশ পেয়ে যায়। নীল কেসটা জানত। শুধু যদি ঠিক সময়
কিছু মনে পড়ে। যতক্ষণে মনে পড়ল অনেক দেরী হয়ে গেছে। কেস রিওপেন করা প্রায় অসম্ভব
কারণ কোনো কঙ্ক্রিট প্রমাণ নেই এবং মেয়েটির বাবা একজন বড় মাপের শিল্পপতি। নীলের
খুব আফশোস হয়েছিল। কিন্তু সে আর একবার বুঝতে পেরেছিল যে বোকা সে নয়।
বোকা নয় বলেই নীল আর কোনো তর্কের মধ্যে গেল না। দেখা করার যায়গা আর
মেয়েটির নাম জেনে নিল। পার্ক স্ট্রীট বারিস্তা। অহনা বসু।
(ক্রমে আসিতেছে)
(ক্রমে আসিতেছে)
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তরমুছুনবেশ ভাল লাগলো...
উত্তরমুছুন