রিজিও ইয়োহানান
রাজ:
প্রণয়ের পরিচিত ভাষ্যগুলি অন্য
একটি বিস্তৃতির দিকে এগিয়ে যায় রিজিও
ইয়োহানান রাজের কবিতায়। শরীরী সংকেত, সরল কুহক এসবকিছুর ভেতরেই আত্মদহন আর অবগাহনের পর্বগুলি নির্মাণ করেন তিনি।
মালয়ালাম এবং ইংরাজি এই দুটি ভাষাতেই লেখেন রিজিও ইয়োহানান রাজ। ‘ইউনাক’, ‘নেকেড বাই দা সবরমতী এন্ড আদার গুনা পোয়েমস’ তাঁর পরিচিত কাব্যগ্রন্থ। তাঁর ‘অভিনাশম’ এবং ‘য়াত্রিকম’ উপন্যাসদুটি অনূদিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভাষায়। এন কুমারন আসান,উদয় নারায়ন সিংহ প্রমুখর কবিতার অনুবাদ করেছেন রিজিও।
তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে,কে
সচ্চিদানন্দনের কাব্যসমগ্র।
রিজিও ইয়োহানান রাজ- এর
কবিতা
ইরোটিকা -১
ছেলেটি বললঃ
চলো, আদর করি
আজ রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে
আর বাতাসও ঘিরে ধরেছে আমাকে
আজ রাতে, তোমাকে একটি রেড ওয়াইনের গ্লাস মনে হচ্ছে
আমার মুখের ভেতর কেঁপে উঠছ
বারবার
(তোমার বাঁ বুকের ঐ নীলচে-
কালো তিলটা
কাঁপতে কাঁপতে তোমার আকাঙ্খার
চিহ্ন হয়ে উঠছে।)
আজ রাতে তুমি একটি মাতাল
সমুদ্র হয়ে উঠেছ
আর উন্মাদের মত গিলে ফেলছ আমার
নৌকোগুলি
(তোমার চুলের তীব্র জরদ, বিদ্যুতের মত
ফুঁড়ে দিচ্ছে আমার কোমরের
মাংস)
আজ রাতে তুমি একটি মৃদু আলোর
ঘর,
যেখানে একটি ছায়া অন্য একটি
ছায়াকে জড়িয়ে ধরছে
(আর অন্তহীন কামনায় ভেসে
যাচ্ছে
আমার ধৈর্যের যাবতীয় চুরুট)
তাড়াতাড়ি কর।
ইরোটিকা -২
১. লাইট হাউস
মেয়েটি বললঃ
আমার স্বপ্নের ভেতর
এখনও রাত্রি নেমে আসেনি
অথচ তুমি একটি লাল রঙের লাইট
হাউস হয়ে গেছ
তুমি
কখনও অন্ধকার সমুদ্রে
তুফান ডেকে আনতে পারোনা
অথচ তোমার শরীর
গেঁথে নেয়
অন্তহীন আকাশের
নীল, ছেঁড়া টুকরোগুলিকে
পাখির বাচ্চারা
তোমার মাথার ওপর বসে
ঝিমোয় আর শিস দিতে থাকে
রামধনুর রঙ, থমকে দাঁড়ায়
তোমার জানালাগুলির ওপর।
একটি একঘেয়ে গানের ভেতর ভাসতে
ভাসতে
দুপুরের বাতাসের বিরক্তি আঁকড়ে
ধরে
তুমি আমার জন্য
আমার উথলে ওঠা সাদা পালের জন্য
দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে থাকো
আমি তোমার ছায়াটির কথা ভাবি
দীর্ঘ,
কাঁপতে কাঁপতে
একা পড়ে আছে গরম বালির ওপর।
২. দাবানল
মেয়েটি বললঃ
যখন তোমার বন জঙ্গল পুড়ে
যাচ্ছিল
তুমি আমার কাছে দৌড়ে এসেছিলে
পোড়া মাংসের ধোঁয়া আর
মশলার গন্ধ জড়িয়ে
আমি তোমাকে দ্রুত গিলে
ফেলেছিলাম
আর জ্বলে গিয়েছিল আমার
পাকস্থলী।
৩. মদ
মেয়েটি বললঃ
আমি পাগলের মত
তোমার রসালো আঙ্গুরগুলো
চটকাচ্ছিলাম
যতক্ষণ না
ফেনার উল্লাস
আর মদের ঘ্রাণ উঠে আসে।
তোমার ঝুলতে থাকা
আঙ্গুরের থোকার নীচে আমি হাঁটু
মুড়ে বসলাম
আমার হাঁ মুখের ভেতর দিয়ে
চুইয়ে নেমে এল মদ
আমার হৃদয়ও নেশায় চুর হয়ে গেল।
৪. পর্ব
মেয়েটি বললঃ
একটি সাদা খরগোশের মত
তুমি আমার কাঁচা উপত্যকা তছনছ
করে দিয়েছিলে
মৃদু শীৎকার ঢেকে দিচ্ছিল আমার
সবুজগুলিকে যখন
তোমার চোখদুটো তাদের লুকোনোর
জায়গা খুঁজে নিচ্ছিল।
একটি বুনো কাঠবেড়ালির মত
আমার ডালপালাগুলো ঘেঁটে
দেখছিলে
আমার প্রথম আমটি তার সুগন্ধ
উদযাপিত করেছিল
যখন তুমি তাঁর স্বাদু চামড়ায়
নখ বসিয়ে দিয়েছিলে।
একটি কালো ভালুকের মত
তুমি আমার এবড়ো খেবড়ো টিলাগুলো
খুঁজে বেড়াচ্ছিলে
মাটি ঝরে পড়ছিল তোমার কালো
শরীরের নীচে
যখন তুমি আমার ঢালে বিশ্রাম
নিচ্ছিলে।
একটি ছোট বাঘের মত
তুমি আমার অযত্নে বেড়ে ওঠা
ঝোপঝাড়ের ভেতর খেলছিলে
আমার শক্ত মাটি বারবার কেঁপে
উঠছিল
যখন তুমি একটি ফড়িংকে তাড়া
করছিলে।
একটি তৃষ্ণার্ত সিংহ-এর মত
তুমি আমার রোদে পোড়া মাটির ওপর
দিয়ে ছুটছিলে
তোমার কাঁধের আগুন আমার দীর্ঘ
ঘাসগুলিকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল
যখন তুমি আমার ঝর্নার মুখটা
খুঁজে বেড়াচ্ছিলে।
একটি সাদা বুকের মাছরাঙার মত
তুমি আমার হ্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়লে
গভীরে। আরও গভীরে ঢুকে গেল
নীল ডানা,সবকিছু।
লাফিয়ে নেমে এল আমার জলধারা।
৫. মেয়েটি যা বলেছিল
মেয়েটি বললঃ
তুমি আমার দিকে দৌড়ে আসছিলে
তবু আমি তোমাকে দেখতে পেলাম
না।
তুমি আমার খুব কাছে চলে এলে
তবু আমি তোমার গন্ধও পেলাম না।
তুমি আমার কানে ফিসফিস করে
কিছু বললে
আমি তোমার একটি কথাও শুনতে
পেলাম না।
তুমি আমায় চুমু খেলে
আমি তোমার জিভের স্বাদ পেলাম
না।
তুমি আমার ভেতরে ঢুকে পড়লে
তবু তোমার কোন স্পর্শ পেলাম না
আমি।
অথচ সারাক্ষন ধরে ভালোবাসার মত
কি একটি
জেগে থাকল আমার শরীরে
অন্ধ
অসাড়
বধির
স্বাদহীন
মূক,
যা কিছু আমি ভালবাসি।
৬. গান্ধর্ব
মেয়েটি বললঃ
তুমিই শব্দ,গান
দেবতারা তোমাকে আক্রোশে
স্বর্গ থেকে ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছে।
তোমার গান তোমার সাথেই আছে
খুব ভোরে
যখন বৃষ্টি হয়
আমি জেগে যাই
একটুকরো অন্ধকার আকাশের জন্য
ছটফট করি।
৭ কণ্ঠস্বর
মেয়েটি বললঃ
তোমার কণ্ঠস্বর তোমার আর্তি
বয়ে বেড়াচ্ছে
অথচ আমি তোমাকে কিছু বলতে গিয়ে
থেমে যাচ্ছি বারবার।
৮. ঋতু
মেয়েটি বললঃ
তুমি আমার ওপর উঠে এলে
আমার শরীরে ঝলমল করে উঠল
পাতা, কুঁড়ি
আর ফুলের উৎসব
আমি তোমাকে আমার বসন্তকাল ভেবে
নিলাম।
তোমার গাঢ় আদরে
আমার পাপড়িগুলি
পুড়ে যাচ্ছিল
তবু ফলের ভারে ঝুঁকে পড়ে,
আমি তোমায় গ্রীষ্ম বলে ডাকলাম।
আমাকে জড়িয়ে ধরলে তুমি-
তোমার কাঁধের ওপর
একটি কাঠবেড়ালি
তোমার মাথার ওপর
একটি নীল পাখি
আমার পাতাগুলি শিউরে উঠল
লজ্জায়
ঠিক যেন তুমিই আমার শরৎকাল।
তুমি আমার সবকিছু গ্রাস করে
নিলে
আর একটুকরো বরফ আমার ধ্মনীতে
ঢুকিয়ে দিলে
কুঁকড়ে যাওয়া একটি হৃদয় নিয়ে
আমি আর ভাবতেও পারলাম না-
‘আমার শীতকাল কি চলে এসেছে?’
তুমি কি কোনদিন আমাকে বলবে না,
কোন ঋতু তুমি?
৯. যা কিছু আমি জানি
মেয়েটি বললঃ
আমাকে জিজ্ঞেস কোরোনা
এই প্রেম নিয়ে
আমি কিছু বলতে পারব না।
শুধু যেটুকু আমি জানিঃ
যখন তুমি আমার কাছে থাকো,
তোমার নিঃশ্বাসের ভেতর আমি
ছোটবেলার বুড়ো তেঁতুলগাছটির
গন্ধ পাই ।
তোমার চোখের ভেতর সবুজ আকাশের
ছায়া,
ঐ রকম টিয়াপাখির ঝাঁকের মত
সবুজ
ধান কাটার সময় যারা ক্ষেতের
ওপর নেমে আসত।
তোমার গলার অস্ফুট স্বর
একটি দীর্ঘ গুডফ্রাইডের
মোমবাতির মত
আমাকে জাগিয়ে রাখে।
আর যতবার তুমি আমাকে চুমু খাও
তোমার স্বাদু ঠোঁটদুটো আমাকে
হারিয়ে যাওয়া আমগুলির দিকে
নিয়ে যায়।
আমি ঐ অতীতকে ভুলে যেতে পারি
না।
পাশ ফিরি
তোমার দিকে তাকাই।
১০. শেষ মাথাটি
মেয়েটি বললঃ
এটা দশনম্বরঃ
এটাই তোমার শেষ মাথা।
আমি জানি, তোমার আরও অনেকগুলো মাথার দরকার
আমাকে দেখার জন্য,আমার কথা শুনতে,আমার ঘ্রাণ নিতে,চুমু খেতে
কিন্তু আমার এতকিছু, কিভাবে সামলাবে তুমি?
কুড়িটা হাত দিয়ে তুমি আমাকে
জাপ্টে ধরে রাখতেই পারো
কিন্তু ভাবো, আমাকে ভালোবাসার জন্য
তোমার কাছে শুধুমাত্র একটি
হৃদয়ই আছে।
নাহ্ ! দশটি মাথাই তোমার জন্য
যথেষ্ট।
ভাষান্তরঃ শৌভিক দে সরকার
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
চয়ন ভালো। গভীরতায় অসামান্য।
উত্তরমুছুন