– সন্ধেবেলা
পাখিদের ফিরে আসা দেখতে তোমার ভালো লাগে না জুঁই?
– না। আমার
চানাচুর খেতে ভাল্লাগে। হলদিরামের।
সুশান্তর এটাই ছিল সমস্যা। তার
বউ। এমনিতে খারাপ কিছুই নেই। কিন্তু খালি সব কথাতেই হলদিরাম, আমুল, ব্রিটানিয়া থেকে
আরম্ভ ক’রে গোদ্রেজ, স্যামসাং, এল.জি... এই
ভূ-ভারতে তেত্রিশ কোটি ব্রান্ডের কিছুই বাকি ছিল না। তাই নিয়েই তার সারাদিনের
সোহাগ আদর ভালোবাসা... ব্যাপারগুলো কখনও কখনও অবিশ্বাস্য ঠেকত সুশান্তর। এমনকি
মাঝেমধ্যে সন্দেহও হত মাথায় কোনো গোল নেই তো!
বাড়িতে একটা টিভি আগেই ছিল, এল.জি। তারপর হলো কম্প্যুটার, ডেল... তার সাথে ইন্টারনেট, বি.এস.এন.এল
ব্রডব্যান্ড... এই সব সে করেছে বউ-এর আবদার অভিযোগ মেটাতে। সব হলো। একদিন অফিস
থেকে বাড়ি ফিরে দ্যাখে বউ বি.এস.এন.এলের মোডেমটাকে এন্তার ঝাঁটা পেটাচ্ছে। “কী ব্যাপার?” জিজ্ঞাসা করতেই রাগে দুঃখে তার চোখে জল।
– প্রতি মুহূর্তে
মুহূর্তে কানেক্সন যায়, এক মাস ধ’রে এই চলছে, সিনেমা দ্যাখা যায় না, গান শোনা যায় না। জীবনটা অতিষ্ঠ ক’রে দিল। কমপ্লেন করেও কিচ্ছু হয়নি জানো?
– আহা তা ব’লে এর’ম খামোখা মাথা গরম করবে?
– খামোখা? এটা খামোখা? ওরা দিনের পর দিন মানুষ ঠকিয়ে যাবে, আর চোখের সামনে সেটা দেখতে হবে? কেউ কিচ্ছুটি বলবে না? আমরা টাকা দিতে কয়েক দিন দেরি করলেই তো কানেক্সন কেটে দেবে... আর নিজেদের বেলা? টাকা নিয়েও যে কানেক্সন দ্যায় না তার বেলা? আমার তো মনে হয়, গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড নোটে লিখে দি – আমার মৃত্যুর জন্য বি.এস.এন.এল দায়ি, তারপর দেখি ওরা কী ক’রে ব্যবসা চালায়।
সুশান্তর হাসি পায়। বলে,
– তা ব’লে নিজেদেরই টাকা দিয়ে কেনা মোডেমটাকে যে পেটাচ্ছ, ভেঙে গেলে তো আবার আমাদেরই কিনতে হবে।
– যাক। সব ভেঙে যাক। ওদের দেওয়া কিচ্ছু আমার চায় না। এই মোডেমটাকে ভেঙে, বি.এস.এন.এল-এর কুশপুত্তলিকা দাহ করছি ভাবব।
এইভাবেই কখনও টিভির নব খোলা, তো ওয়াশিং মেশিনের মাথায় হাতুড়ি। এগুলো রাগের। আবার শান্ত হলে, সেই চোটগুলোয় সুন্দর ক’রে ডেন্ড্রাইট লাগিয়ে আদর যত্ন করাটাও একইভাবে চলত।
আমরা হাসাহাসি করতাম। আর সুশান্ত ব্যাজার মুখে বলত, “জুঁই-এর মাথাটা কোনদিন পুরো যাবে। কোনো ডাক্তার জানিস?”
জুঁইকে ডাক্তার দ্যাখানোর কথা সুশান্ত মজা করেই বলত। আমরা সেটা জানতাম। তাই ওর ওই ব্যাজার মুখের উক্তিতে আরও হাসি বাড়ত।
কিন্তু শেষ যেদিন ও ওই একইভাবে ডাক্তারের খোঁজ করছিল, বুঝিনি সেটা মজা ছিল না। দিনটা আজও মনে আছে। জুঁই-এর সাধ। আমরা সবাই অফিস থেকে নেমতন্ন খেতে গেছিলাম। খাওয়াদাওয়ার পর আমাকে একা সিঁড়ির ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে সুশান্ত ঠিক এই কথাটাই বলল,
– কোনো ডাক্তার জানিস? সাইক্রিয়াটিস্ট?
– কেন রে জুঁই আবার কী ভাঙল? – আমি হাসি।
সুশান্ত হাসল না। চোখ মাটিতে নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল।
– জুঁই নয়। আমার... নিজের জন্য।
– বুঝলাম না। তোর আবার কী হলো?
– রোজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখি। রোজ একই স্বপ্ন। আর তারপর ঘুমটা ভেঙে যায়। গোটা রাত আর ঘুম পায় না। সব সময় বাজে চিন্তা আসে মাথায়। কাউকে বলতে পারি না।
– কী স্বপ্ন?
– বাচ্চাটা হবে। তাকে নিয়ে। বলবি না তো কাউকে?
– না রে পাগলা। বল।
– দেখি, জুঁই ঘুমিয়ে আছে। আর আমি ওর পাশে ব’সে ওর পেটটায় হাত বোলাচ্ছি। ঠিক এমন সময় দরজা ভেঙে প্রায় জনা তিরিশেক বা তারও বেশি লোক ঢুকে পড়ল ঘরটায়। প্রত্যেকের হাতে তলোয়ার – সিঁদুর মাখানো। আমি ভয় পেয়ে যাই। জুঁইকে ডাকি। ধাক্কা মারি। কিন্তু ও ওঠে না। লোকগুলো আমার সামনে ঝুঁকে আসে। যেন অনেক উঁচু থেকে ওদের মুখগুলো নেমে আসছে, এরকম একটা পার্সপেক্টিভে। বলে, “আমরা রিলায়েন্স ফ্রেসের মালিক। তোমার বউ চুরি ক’রে আমাদের কিমতি আপেল খেয়ে ফেলেছে। আমরা ওর পেট থেকে সেটা নিয়ে যেতে এসেছি।”
আমার মজা লাগে। কিন্তু সুশান্তর চোখ-মুখের অবস্থা দেখে নিজেকে সংযত করি। বলি,
– তারপর?
– আমি কোনো কথা বলতে পারি না। হাত পা কীরকম জড়ো হয়ে ঠান্ডা লাগে। ওদের বোঝাতে চাই, ও প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তার আগেই ওরা জুঁই-এর তলপেট তলোয়ার দিয়ে ফালা ক’রে দ্যায়।
সুশান্ত চুপ করে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখি। আর আমার দিকে তাকিয়ে এবার ও হাসে।
– সবচেয়ে আশ্চর্যের কী জানিস? ওর পেট থেকে নাড়ি-ভুঁড়ি কিচ্ছু বেরোয় না। শুধু গাদা গাদা কাগজ বেরোয় – বিজ্ঞাপনের। শ্রী-লেদার্সের চটির বিজ্ঞাপন, কেশধী তেলের বিজ্ঞাপন, কোলগেট টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন... গাদা গাদা কাগজের টুকরো। গোটা ঘর ভ’রে যেতে থাকে। সবকিছু ঢাকা প’ড়ে যায়। সিনেমায় যুদ্ধে লাশের ভিড় যেমন দ্যাখায়, তেমনই। আর সেই কাগজ সরিয়ে সরিয়ে ওই লোকগুলো ওদের আপেল খুঁজতে থাকে। আমি খুঁজতে থাকি বাচ্চাটাকে। পাই না। কেমন একটা হারিয়ে ফেলার ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়।
সুশান্ত থামে। আমি প্রাথমিকভাবে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। সেই ঘোর কাটিয়ে ঠিক কিছু বলতে যাব, এমন সময়ই জুঁই ঢুকল ঘরে। আমায় দেখে একগাল হাসি।
– আরে ইন্দ্রদা যে। গল্প চলছে বন্ধুর সাথে? ভালই হয়েছে তোমাদের আলাদা পেয়ে। আচ্ছা ডেলিভারির আর ক’দিন বাকি বলো? ওকে একটু বোঝাও তো, সময় থাকতে থাকতে জনসনের বেবি ইউটিলিটিস কিনে রাখতে।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
গ্লপ্টা ছোট হলেও অসাধারণ, অসাধারণ, অসাধারণ!!!
উত্তরমুছুন