মায়ানমারের শূন্য দশকের কবি কো কো
থেট-এর কবিতা
অনুবাদ
: অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
বার্মিজ কবিতার আধুনিক পর্ব (‘খিতসান’/‘টেস্টিং দ্য টাইম্স্’ নামে পরিচিত) শুরু হয় ১৯৩০ নাগাদ। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রিটিশ
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিরোধিতার সাথে যা সম্পৃক্ত ছিল। সেই থেকে বার্মিজ কবিতা
একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যতা ধারণ করে এসেছে। ১৯৬২-তে সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর,
সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সব দিক থেকেই বার্মা/মায়ানমার একটি রুদ্ধদ্বার দেশে পরিণত
হয়। রাজনৈতিক পণ্ডিতদের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘a
stone age cave sealed by stone’.
‘অন্য ভাষার কবিতা’য় এই সংখ্যায় থাকছে মায়ানমারের
শূন্য দশকের কবি কো কো থেট-এর কবিতা। কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক কো কো থেট-এর জন্ম
ইয়াঙ্গনে (রেঙ্গুন)। ১৯৭২-এ।
কবিতা লেখেন ইংরেজি ভাষায়। থেট-এর জীবন অন্যান্য অনেক কবির মতো শান্ত ও শাদামাটা
নয় একেবারেই। বরং ঘনঘটাপূর্ণ ও বর্ণময়। ’৯৫-তে ইয়াঙ্গন
ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (YIT)-তে পড়ার সময় সরকারি নিষেধাজ্ঞায়
গোপনে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন ‘ওল্ড গোল্ড’। ‘ফিউনারেল অফ ওল্ড গোল্ড’ বেরোনোর পর থেটকে
গ্রেপ্তার এবং আটক করা হয় ’৯৬ ডিসেম্বরের
ছাত্র-অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার কারণে। ’৯৭-এর এপ্রিলে ছাড়া
পেয়ে YIT এবং দেশ, দুই-ই ছাড়েন। চলে যান সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে
ব্যাংকক। ব্যাংককে জেস্যুট রিফিউজি সার্ভিস এশিয়া প্যাসিফিকে তিন বছর কাজ করেন। ২০০০
সালে যান ফিনল্যাণ্ড। পড়াশোনা করেন হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ভিয়েনায়।
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টে। বর্তমানে
বেলজিয়ামে থাকেন।
২০১২ সালে থেট এবং James Byrne-এর যৌথ-সম্পাদনায় ও অনুবাদে
প্রকাশিত হয়েছে বার্মিজ কবিদের কবিতার সংকলন— ‘Bones Will Crow: 15 Contemporary Burmese Poets’. প্রায় এক হাজার জন কবির মধ্যে থেকে বেছে এই পনেরো জন সংকলনভুক্ত হয়েছেন।
থেটের মতে, সেজন্যেই এটি এই প্রোজেক্টের একমাত্র কাজ হতে পারে না। রাজনৈতিক কারণে
জেলবন্দী কিম্বা বিদেশে নির্বাসিত বা পালিয়ে থাকা সমসাময়িক পনেরো জন কবির লেখা
নিয়ে এই সংকলন। ২০১২-তে এই বইটি ইংলিশ পেন রাইটার্স (ট্র্যান্সলশন প্রোগ্রাম
বিভাগে) পুরষ্কার পায়। ঐ বছরই বইটি ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর বার্মার সেরা দশটি বইয়ের তালিকায় চলে আসে।
এ’ বছর, ২০১৫-তে প্রকাশিত হয়েছে
থেট-এর প্রথম কবিতার বই ‘The Burden of Being Burmese’. এই বইটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম কোনো বার্মিজ কবির পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বই।
থেট নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘এ পোয়েট বাই চয়েস
অ্যাণ্ড এ বার্মিজ বাই চান্স’। যদিও বার্মিজ
সাবজেক্টিভিটিই ওঁর ‘The Burden of Being Burmese’ বইটির প্রধানতম
বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক দোদুল্যমানতার মধ্যে দিয়ে বার্মিজ ভাষার
কথনীয়তাকেই সুসংহত ভাবে প্রকাশ করেছে ওঁর এই বইয়ের ভাষা। বার্মিজ ভাষার syllable-timed
nature-কে, তার সুর-বৈচিত্র্যকে ইংরেজিতে অনুসৃজিত ক’রে তোলার একটা প্রয়াস দেখা যায় ওঁর লেখার ভাষায়। বিষয়, ভাষা এবং আঞ্চলিকতার
মধ্যে দিয়ে ‘The Burden of Being Burmese’-এর ভাষা সবসময় চায়
একটা সীমানা ভাঙতে ; যে ভাষা মূলতঃ একনায়ক শাসনতন্ত্রের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলে।
এই
পৃথিবীর নাভির দিকে
[‘সুপ্রসন্ন বিজয়’, হাইওয়ে বাস-টার্মিনাস,
ইয়াঙ্গন]
ইঁদুরকলে এক বিরাট শাদা রঙ ধরা পড়েছে
বারো
ঘন্টায় একবছরের বর্ষাকাল
উড়ে
বসা এক পোকার জন্য কামানগোলা
চাষিমেয়ে
ফেরি করছে সামান্য টুকিটাকি
জঙ্গল
তোলপাড় ক’রে চলা হাতি
নিজের
রাস্তাটা উপড়ে ফেলছে না
কোনো ‘না’ সে শুনবে না
এই
বমি বমি ভাব কাটানোর জন্য তোমার ইনহেলারও দরকার পড়বে না আর
আমার
আবেদন এবারে ফেলে দেবো আমি
একটা
টিস্যু-প্যাকেট পেতে পারি কি
......
[অভীচি* নরকের জন্য একটি অনুদান প্রকল্প, লাল পৃথিবীর টিলা]
বার্মিজ মিডিয়াম স্কুল, এখানেই আমি শিখেছিলাম ভূতেদের ভাষা
এটা
এমন এক ভাষা, সেক্সের ব্যাপারে যা কখনোই তোমায় ভালো কিছু ভাবতে দেবে না।
আকাশটা
যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে-টেঙে পড়তে পারে ব’লে
আমরা
শক্ত একটা হ্যাট প’রে বাইরে বেরুতাম
স্টীলের
জুতো প’রে থাকতাম পাছে ফাঁদে না
পা-আটকে যায়
স্তূপ
নির্মাণের পর আমরা ছিঁড়ে ফেলবো পৃথিবীর সব ফাঁসির দড়ি, মঞ্চ ও ফাঁসিকাঠ
ব্রিটিশরা
একদা এ’ দেশ দখল করেছিল
এখন
কোকা-কোলার উপনিবেশ হয়েছে এ’ দেশ
অভীচি
নরকের জন্য মুক্তহস্তে কিছু দান করুন
*অভীচি— In Buddhism, Avīci (Sanskrit and Pali: ‘without waves’ ; also transliterated
Avichi) is
the lowest level of the Naraka or ‘hell’. Suffering in Avīci
is the longest of all the levels of hell, by some accounts over 1018 years
long. For this
reason, Avīci hell is also known as the ‘non-stop
way’. Avīci is often translated into English as ‘interminable’
or ‘incessant’.
[হাজার,
লক্ষ, কোটি]
আপনার সব আরাম আর লাক্সারী বাড়িতে রেখে আসুন
জুতো
মুছতে হ’লে ওই কাঠের পাটাতনের ওপর রেখে
মুছুন
সীটের
ওপর কখনোই পা তুলে বসবেন না
জানলার
কাচ খুলতে যাবেন না অহেতুক
মালিকনাহীন
ব্যাগের দায়িত্ব আমাদের নয়
এই
বাসে ভাত খাওয়া নিষিদ্ধ। কঠোরভাবে।
গাড়ি
কখন ছাড়বে, অবশ্যম্ভাবীভাবে চালক তা’ জানেন না
ধূমপান
করবেন না, অনুগ্রহ ক’রে আপনার চারপাশ পরিচ্ছন্ন
রাখতে সাহায্য করুন
বুদ্ধং,
ধর্মং, সঙ্ঘং
আপনার
যাত্রা শুভ হোক
দ্য
বার্ডেন অফ বিইং বার্মিজ
হীরে বাঁচানোর জন্য
কাঠের
গুঁড়ো আর চিংড়ি বাটার মধ্যে
এ-ও
এক বেঁচে থাকা
বাঁশের টিউবের ভেতর
এ’ এক চিকন চাঁদ গো
‘আহা! আমি কি সুস্বাদু!’
ভাবছে
খড়ের স্তূপে এ’ এক আগুন লেগেছে
জ্বলে
উঠছে হঠাৎ
যাঃ! তড়িঘড়ি
নিভে গেল
তোমার কর্ড কোনটা
মেজরিটি
আছে মাইনর-সি’তে আর মাইনরিটি ধরেছে মেজর-ডি
যুদ্ধ-বিরতি
ডাকা হোক বি-ফ্ল্যাটে আর সব পরিচয় খোয়া যাক জি-শার্পে এসে
অস্বাভাবিক
একটা সুর দাও দেখি আমায়
ইম্প্রোভাইজ
করো
না
না, হারমোনি-টারমোনি চাই না
কোনটা পছন্দ করবে
ক্রোধ
না অবিদ্যা
এ’ যুদ্ধে পরাজয় মেনে নেওয়া না অনুন্নয়ন
বাড়তে
থাকা এই বিষের বোঝা নাকি কমতে থাকা ইন্টারনেটের স্পীড
যৌন-নিবিষ্ট
না আত্ম-অস্বীকারী
লোডশেডিং
না তড়িৎ-বাতিক
এক
ব্যাগ চাল না এক আউন্স গণতন্ত্র
অসঙ্গতির
সুসঙ্গতি
না চিরশত্রু
চিরবিরোধী
চারটি
মহান সত্য
শপথ
চারটি.....
.......................
.......................
.......................
অনেক
লম্বা মেনুকার্ড
যে
মরবে এখানে, ছুঁড়ে ফেলা হবে
জীবনটা ছোটই
তকলিফগুলো
বড়ো
প্রচুর
জল আছে এখানে
মাছ
নেই, মাছের বংশ নেই কোথাও
ইতিহাসের
সাথে দু-চার পা
মং থা
নো-কে
সে ভাষায় তুমি ইতিহাস কিভাবে লিখবে
যার
কোনো অতীত কাল নেই
একবারের বেশি এ’ আমি জানতে চাই নি
ইতিহাস
হোঁচট খেয়েছে আমার ওপর
তার একটা অংশই বা কিভাবে হবে
যদি
না পাত-পেড়ে খেতেই বসলে তার সাথে
অ্যাডামের আপেলে যে পোকাগুলো ছিল, সেটাই ইতিহাস
এর
হাতেই পাইনের ছাল হয়ে গেছে গমের রুটি
ছদ্ম-যুদ্ধ
জাহাজে পচা মাংসের রেশন হয়ে থেকেছে
তেলের
দামের ওপর ঘুরেছে পর্যটকের মতো
এ-ই
ছিল নরকের রান্নাঘরে শেফ
তোমার শহরের খবর কি বলো
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের ওপর আর
কন্সট্রাকশনের
নীচে ফ্লাইওভার
ক্লিওপেট্রা কখন নামবেন এই শহরে?
এই রাতভোর, আড়াইটের মতো বাজলো বোধ’য়
কিছু ঘোষণা করেছেন কি উনি?
নাহ্
এরা
তো ফালা ফালা ক’রে তছনছ করেছে ওকে, যেভাবে
পেরেছে
কি পেলো খুঁজে?
বাঁশির শব্দ, শিস, শাঁখ
বিপন্ন
এক চুরুট কারখানা
বেফালতু
একজোড়া বিপ্লবী অভ্যুত্থান
যমজ
দুই ছেলেকে নিয়ে এক সাইকোলজিস্ট
ভিড়
ঘিরেছে তাদের
বর্ণবাদ
আর এই পাল্টা বর্ণবাদ
আর
অস্বাভাবিক শাদা এই আরশোলা, একজন ফেক হিপোক্রিট
এবং
একজন অভিবাসী, যার নাম
তুমি
কখনো জানতে পারবে না
একটি
শহরকে কাঁচা খেয়ে ফেলার কয়েকটি উপায়
[যখন
কোথাও তুমি ফুরিয়ে যাচ্ছ, কিন্তু চাইছ না]
খাও, মালয় দ্বীপের এই ফলের মতো খাও একে
এমন
ভাবে খাও যেন এ’ ফলের নাম শুনেই কেউ বমি করেছে
হড়হড়
এই
দ্বীপে তামার মতো রঙ হয়েছে তোমার
এর
সমস্ত আকার এবং সৈনিকের মোজার দুর্গন্ধ, ঘেন্না ঘেন্না তোমার
ততক্ষণ
তুমি অপেক্ষা করবে, যতক্ষণ না আর কোনোভাবেই অপেক্ষা সম্ভব নয়
খাও,
অথবা মরো। এখন তুমি সেরা বর্গের স্তন্যপায়ী প্রাণি হতে পারো। যেমন আগেও বরাবর
ছিলে।
পাথরে
থেঁতলনো হবে শস্যের খোসা, তুষ
তোমার
সংখ্যা খনন ক’রে ক’রে তার নরম, রসালো মণ্ড অবধি যাও
তুমি দেখতে
চাইছ না, গন্ধও চাইছ না তার
তোমার
শ্বাস চেপে রাখো, অথবা চেপে ধরো নাক
ঠেলে,
ঠেসে ঢুকিয়ে দাও মাংস তোমার মুখে
তুমি
অভ্যস্থ হয়ে যাবে এতে
[যাত্রাপথে]
হাঁটতে হাঁটতেই খাওয়া যেতে পারে, যেন তুমি নিজেই এক-বাক্স নুডল্স্
জেট
প্লেন চালানোর চেয়ে সাইকোমোটরটা বুঝে ফেলাটাই সুবিধেজনক
তোমার
আঙুলের তোমার চামচকে জানা উচিত
তোমার
পায়ের চেনা উচিত তোমার হেঁটে যাওয়া
তোমার
মুখকে জানতে হবে তোমার কামড় কাকে বলে
তোমাকে
তোমার রাস্তাটাও তো জানতে হবে
জেব্রা ক্রসিং, লাল আলো, সবুজ আলো, হলুদ আলো, কুকুরের হেঁটে যাওয়া,
জ্জজ্জজ্জ
শব্দে চলে যাচ্ছে সাইকেল, মহিলা পুলিশ, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিয়ে-জন্মদিনে
ভাড়া দেওয়ার জন্য গজানো নতুন বাড়ি, কেতাদুরস্ত অঞ্চলবাসী, লোকজন...
শুধুমাত্র মানুষ এবং অন্য প্রজাতির কিছু প্রাণিই বোধ’য় পা দিয়ে খেতে পারে।
তোমার
নুডল্সের বাক্স ফাঁকা হয়ে গেলে একটা ডাস্টবিন খুঁজে নাও
ফেলে
দিয়ে, হাঁটতে থাকো আবার...
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
বাহ
উত্তরমুছুন